রূপগঞ্জে চাঞ্চল্যকর ও ক্লু-লেস জাহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক রহস্য উদঘাটন এবং মূল হত্যাকারীসহ ৭ আসামিকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন।
মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব ১১ এর অধিনায়ক ল্যাফটেনেন্ট কর্ণেল তানভীর মাহমুদ পাশা।
তিনি জানান, ২১ জুলাই নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন টেংরারটেক সাকিনস্থ এশিয়ান হাইওয়ে রোডের পশ্চিম পাশের মাল্টিব্রান্ড গ্রুপের বাউন্ডারি সংলগ্ন ডোবার মধ্যে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। ২৪ তারিখ হাসপাতাল মর্গে উপস্থিত হয়ে মোঃ কাজল হোসেন (২১) নামক এক ব্যক্তি লাশের আলোকচিত্র, লাশের পরনে থাকা কাপড় দেখে লাশটি তার বাবা জাহিদুল ইসলামের বলে সনাক্ত করে। উক্ত ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরূদ্ধে নিহতের ছেলে মোঃ কাজল হোসেন বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহসহ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও ঘটনায় জড়িত অজ্ঞাতনামা আসামীদের গ্রেফতারে র্যাব-১১ এর একটি গোয়েন্দা দল ছায়া তদন্ত শুরু করে। র্যাব তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে উক্ত ক্লু-লেস ও লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়। অতঃপর র্যাব-১১ এর অভিযানে ১৬ আগস্ট রাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে উক্ত ক্লু-লেস ও লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত প্রধান আসামি অজ্ঞান পার্টি চক্রের মূলহোতা গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার আদর্শ গ্রামের মো গফুর আলীর ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩০) কে গ্রেফতার করে।
একই সাথে তার সহযোগী অন্যতম আসামি পঞ্চগড় জেলার মসজিদপাড়ার মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মোঃ শামীম (৪০), গাইবান্ধার দূর্গাপুরের ইব্রাহীম খলিলের ছেলে রনি মিয়া ওরফে টনি (৩০), রংপুরের পীরগাছার ইব্রাহীম শেখের ছেলে আঃ মান্নান শেখ (২২), নাটোরের সিংড়ার পুটিমারীর লস্কর প্রমাণিকের ছেলে মোঃ সুমন (৩৮), বাগাতিপাড়ার গালিমপুরের মৃত তাইজ উদ্দিনের ছেলে মোঃ মামুনুর রশিদ (৩৫) ও গাজীপুরের জয়দেবপুরের চান্না বৌবাজার এলাকার মৃত ইয়াসিনের ছেলে মোঃ হাবিবুল্লাহ (৫২) কে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক অনুসন্ধান ও গ্রেফতারকৃত আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ১৮ জুলাই রাতে উক্ত অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা মোঃ সাইফুল ইসলাম ঢাকার কেরাণীগঞ্জ হতে এবং তার সহযোগী মোঃ রনি মিয়া গাইবান্ধা হতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় অবস্থানরত মোঃ শামীম, মোঃ আঃ মান্নান শেখ, মোঃ সুমন, মোঃ মামুনুর রশিদ ও মোঃ হাবিবুল্লাহসহ ৯ জনের একটি দল সাইফুলের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। উক্ত চক্রের মূলহোতা সাইফুলের একজন অন্যতম সহযোগীসহ আরও ৫ জনের একটি দল নাটোর থেকে ১টি ট্রাক নিয়ে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা এসে সাইফুলের দলের সাথে মিলিত হয়। ১৯ জুলাই ভোর রাতে নারায়ণগঞ্জ হয়ে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, তারা ঘটনার দিন দুপুর বেলা কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় এসে পৌছালেও তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সন্ধ্যার পর উক্ত অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা সাইফুল নিজে যাত্রীসেজে ঈদে ঘরমুখো সাধারণ যাত্রীদেরকে কম টাকায় পরিবহনের আশ্বাস দিয়ে ভিকটিম জাহিদুল ইসলাম (৫০) সহ তার সঙ্গীয় আলম (৫০), আরিফ (৩০), শরীফুল ইসলাম (৫০) ও সবুজ (৩০) সহ মোট ৫ জন যাত্রীকে সু-কৌশলে তাদের ট্রাকে উঠিয়ে নাটোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা উল্লিখিত যাত্রীদের নিয়ে কিছুদূর আসার পরে পথিমধ্যে তাদের দেখিয়ে শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় ক্রয় করে।
পরবর্তীতে তারা ট্রাকের সামনে পূর্ব থেকেই রাখা ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত অনুরুপ শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় সু-কৌশলে পরিবর্তন করে ট্রাক চলাকালীন সময়ে ভিকটিম জাহিদুল ইসলামসহ ৪ জন যাত্রীকে খাইয়ে অজ্ঞান করে তাদের কাছে থাকা সবকিছু লুট করে নেয়। একজন যাত্রী উক্ত ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় না খাওয়ায় তাকে বেধড়ক মারধর করে।
পরবর্তীতে উক্ত অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা কুমিল্লার দাউদকান্দি ব্রীজ পার হয়ে প্রথমে ৩ জন যাত্রীকে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। তারপর কিছুদূর আসার পর অজ্ঞান না হওয়া যাত্রীকে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। সবশেষে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন টেংরারটেক সাকিনস্থ এশিয়ান হাইওয়ে রোডের পশ্চিম পাশের ঝোপঝাড়ের মধ্যে ভিকটিম জাহিদুল ইসলামকে গড়িয়ে ফেলে দেয়। ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত শুকনো খাবার ও কোমল পানীয় খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ভিকটিম জাহিদুল ইসলামের নিকট টাকা পয়সা কম থাকায় সাইফুলের নেতৃত্বে আসামিরা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে উপুর্যপুরি কিল ঘুষি ও প্রচন্ড মারধর করে। ঔষধের বিষাক্ত প্রভাব এবং প্রচন্ড মারধর করার ফলে ভিকটিম জাহিদুল ইসলামের মৃত্যু হয় বলে ধারনা করা হয়।
প্রাথমিক অনুসন্ধান ও গ্রেফতারকৃতদের নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, উল্লিখিত অজ্ঞান পার্টি চক্রটি দীর্ঘদিন যাবৎ (প্রায় ১০ থেকে ১২ বছর) ঢাকাসহ সারাদেশব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় কখনও এককভাবে আবার কখনও সংঘবদ্ধ হয়ে খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ মেশানোসহ বিভিন্নভাবে যাত্রীদের অজ্ঞান করে টাকা, মূল্যবান সামগ্রীসহ যাত্রীদের সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে আসছিল।
গ্রেফতারকৃত উক্ত চক্রের মূলহোতা মোঃ সাইফুল ইসলামসহ তার সহযোগী অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটনের দায়ে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায় যা ক্রাইম ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বিশ্লেষণ করে সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, উক্ত অজ্ঞানপার্টি চক্রের মূলহোতা মোঃ সাইফুল ইসলামের নামে চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে চুরি করার অপরাধে গত ২০১৬ সালে ২৯ নভেম্বর তারিখে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় ১টি, ২০১৯ সালে একই থানায় জুয়া আইনে ১টি এবং ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল তারিখে বগুড়া সদর থানায় চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে চুরি করার অপরাধে ১টি সহ মোট ৩টি মামলা রয়েছে।
সে ২০১৬ সালে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় রুজুকৃত মামলায় গ্রেফতার হয়ে ৩ মাস ও ২০১৯ সালে একই থানায় রুজুকৃত মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১৫ দিন কারা ভোগ করে। আসামি মোঃ রনি মিয়া টনি এর বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানায় নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে অটোভ্যান চুরি করার চেষ্টার অপরাধে ও ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানায় প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করার অপরাধে ২টি মামলা রয়েছে। উক্ত ২টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে সে সর্বমোট ৩ বছর কারাভোগ করে।
আসামি মোঃ আঃ মান্নান শেখ এর বিরূদ্ধে ২০২০ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানায় চুরি করার অপরাধে ১টি মামলা রয়েছে। উক্ত মামলার প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেফতার হয়ে সে ৫ দিন কারাভোগ করে। আসামি মোঃ মামুনুর রশিদ এর বিরূদ্ধে ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার জিআরপি থানায় ১টি, ২০০৮ সালে ৭ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুর ও বড়াইগ্রাম থানায় নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করিয়ে চুরি করার অপরাধে ২টি ও ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি নাটোর সদর থানায় একই অপরাধ সংঘটনের দায়ে ১টি সহ মোট ৪টি মামলা রয়েছে। উক্ত আসামি ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার জিআরপি থানার মামলায় সাড়ে ১১ মাস, ২০০৮ সালের পৃথক ২টি মামলায় আড়াই বছর এবং ২০২১ সালের অপর ১টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১৪ দিন কারাভোগ করে।
গ্রেফতারকৃত আসামি মোঃ মামুনুর রশিদ দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ অজ্ঞানপার্টি চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করে আসছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে। একই দিনে উক্ত চক্রটি গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় ৩ জন ব্যক্তিকে ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত কোমল পানীয় মিরিন্ডা খাইয়ে অজ্ঞান করে ১৩ হাজার টাকা এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এক গরু ব্যবসায়ীকে একই কায়দায় অজ্ঞান করে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার লুট করে নেয় বলে স্বীকার করে।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন বলে জানায় র্যাব।









Discussion about this post