শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) বিকেলে শহরের চাষাঢ়ায় নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জেলা ও মহানগর এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ জেলা ও মহানগর যৌথ উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। সমাবেশের ব্যানারে উল্লেখ করা হয় ‘রুখো সাম্প্রদায়িকতা, বাঁচাও বাংলাদেশ’ মেয়র আইভী সহ তার পরিবার কর্তৃক শ্রী শ্রী রাজালক্ষ্মী নারায়ণ জিউস পুকুর সহ নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যান্য দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার এর দাবি।’
তাদের ব্যানারে যাই লেখা থাকুক তাদের বক্তব্য ছিল শুধু মেয়র আইভীর বিরোধী। মেয়র আইভীকে যেন সিটি শুক্রবার কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া হয়।’
এমন প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ গ্রহণের পূর্বে নারায়ণগঞ্জ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতা করজোড়ে মিনতি করে নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট এর সাথে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমি পরছি ভাই ফাটা বাঁশে । আমাদের নেতারা কে কি করতেছে তা সকলেই জানেন । শুধু মুখ খুলতে পারি না । মুখ খুললে কি যে হবে তা ভাষায় বুঝাইতে পারমু না । আমি ও আমাদের মতো অনেকেই জিম্মি হয়ে পরেছে । কিচ্ছু করার নাই । অথচ ভগবানের কসম আমি ভোট কিন্তু আইভীরেই দিমু।
চাষাঢ়া এলাকার বাসিন্দা চৈতন্য দাস বলেন, ‘এসব হিন্দু নেতারা মানববন্ধন আর সমাবেশ করে শুধু জিউস পুকুরের দেবোত্তর সম্পত্তি দখল মুক্ত করতে চায়। কিন্তু দখল তো শুধু মেয়র আইভী ও তার পরিবার করেনি। আরো অন্তত ২০ থেকে ২৫জন দখল করে আছে। তাদের নাম কেন বলা হচ্ছে না। আমিও চাই দেবোত্তর সম্পত্তি দখল মুক্ত হোক। যারা সম্পত্তি দখল করে রাখছে তাদের সবাইকে উচ্ছেদ করে পুকুর দখল মুক্ত করা হোক।’
তিনি আরো বলেন, ‘এসব নেতারা সুবিধাভোগী। একটি পক্ষের সুবিধা নিয়ে এসব কর্মসূচি করছে। যা তাদের বক্তব্যে প্রকাশ পায়। শারদীয় দুর্গাপূজায় এতোগুলো প্রতিমা ভাঙচুর করা হলো। তারা কোন কিছুই করেনি। লোক দেখানে একদিন মানববন্ধন করে চলে গেছে। আর সেই মানবন্ধনেও মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে বক্তব্য। তারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সার্থে কাজ করবে তা না করে তারা বরং চায় মেয়র আইভীকে যেন দলীয় মনোনয়ন না দেওয়া হয়। তারা কেন চাইবে আইভীকে মনোনয়ন না দেওয়া হোক ? এতেই স্পষ্ট যে তারা স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য এসব কিছু করছে।’
এছাড়াও নতুন করে অভিযোগ করা হচ্ছে শহরের পশ্চিম দেওভোগ এলাকায় মেয়র আইভী ও তার পরিবারের বাসভবন ‘চুনকা কুটির’ নিয়ে। মেয়র আইভীর প্রতিপক্ষের লোকজন অভিযোগ করছেন, ‘দুর্নীতি করে মেয়র আইভী কয়েক কোটি টাকা দিয়ে বাড়ী করেছেন।’
মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দেওভোগে ‘চুনকা কুটির’ নির্মাণ করা হয়েছে পৈত্রিক ভিটাতে। এই বাড়ি নির্মাণের জন্য মেয়র আইভীর পৈত্রিক দু’টি জমিও বিক্রি করতে হয়েছে। পারিবারিকভাবে নির্মিত এই জমির মালিকানাও মেয়র আইভীর নয়। তার ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যরা এই বাড়ির মালিক। চুনকা কুটির নির্মাণে ব্যয় ৬ কোটি টাকা হলেও এটি নির্মাণে ২০ কোটি বা তারও বেশি খরচ হয়েছে বলে এক ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে দাবি আইভীর পরিবারের লোকজনের।’
এর সঙ্গে প্রতিপক্ষের লোকজন অভিযোগ করেন শহরে ময়লা আবর্জনা পরিস্কার হচ্ছে না। যততত্র ময়লা পরে থাকে। সিটি কর্পোরেশনের লোকজন ভালো ভাবে পরিস্কার করে না। ফলে শহর নোংরা দেখা যায়। এছাড়াও বৃষ্টি হলে শহরের জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নগরীতে মশার উপদ্রব্য বেশি। সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স দিয়েও কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না।’
এসব বিষয়ে বিভিন্ন সমাবেশে মেয়র আইভী নিজেই বলেছেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জের ৯নং ওয়ার্ডে ময়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। করোনা মহামারীতে প্রকল্পের কাজটি থেমে গেলেও পুনরায় চালু হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নগরীতে উল্টো ময়লা শংকট দেখা দিবে। কারণ ওই প্রকল্পে যে পরিমাণ ময়লা আবর্জনা প্রয়োজন হবে সেই পরিমান ময়লা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে উৎপাদন হয় না। তাছাড়া এখনও নিয়মিত ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করা হয়। তবে অসচেতন নগরবাসীই রাস্তায় যততত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখে। এছাড়াও বৃষ্টি হলে নগরীর বঙ্গবন্ধু সড়কে জলাবদ্ধতা হয়। সেটাও আবার ঘণ্টাখানের মধ্যে চলে যায়। তবে এ জলাবদ্ধতা নিরসণেও ডিপ ড্রেন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ শুরু করেছেন মেয়র আইভী। তবে ট্যাক্স দিয়ে দিয়ে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না এ অভিযোগ নগরবাসীর নয় বরং প্রতিপক্ষের লোকজনের যার মেয়র পদে আইভীকে দেখতে চান না।’
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শুরু হয়েছে এক বছর আগে থেকেই। সিটি নির্বাচন আসলেই একটি মহলের মাথা ঠিক থাকে না। তারা নানা খেলায় মেতে ওঠেন। কখনও দেবোত্তর সম্পত্তির নামে, কখনও মসজিদ-মাদরাসার নামে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে উস্কে দিতে চান। তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। কেননা নারায়ণগঞ্জবাসী আইভীকে সৎ, কর্মনিষ্ঠ ও উন্নয়নকামী একজন নেতা হিসেবে চেনেন। মানুষের এই ধারণা যে তারা বদলে দিতে পারবে না সেটা জেনেও নানা বৃথা চেষ্টা চালায়। দুদকে করা দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এই খেলা আগেও হয়েছে। পুরোনো কৌশলে নতুনভাবে আইভীকে জব্দের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। তবে এসব অভিযোগের পেছনে একটি মহল কাজ করছে। তাদের উদ্দেশ্য নারায়ণগঞ্জের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজকে বাধাগ্রস্থ করা। উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতেই এসব করা হচ্ছে বলেই মন্তব্য করেছেন দলীয় নেতারা। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করাকেও সহজভাবে নিতে পারছে না অন্ধকারে থাকা সেই শক্তি। তাই তারা বেছে বেছে এমন সব প্রকল্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যেগুলোতে কোনো না কোনোভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের স্মৃতি রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্র বলছে, ১৯৭৯ সালে লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের সেবায়েতের মাধ্যমে জিউস পুকুরের কিছু অংশ বিক্রি হয়েছে। সেই জমি কিনেছেন অনেকেই। ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর আত্মীয়দের কয়েকজনও। মেয়র নিজে এই সম্পত্তির মালিকানার সাথে কোনোভাবেই জড়িত নন। দীর্ঘ ৩৫-৪০ বছরে এই জমির বিষয় নিয়ে কখনই প্রশ্ন তোলা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে গত একবছর যাবৎ। প্রশ্নটা ‘জিউস পুকুরের সম্পত্তি দেবোত্তর বলে রক্ষার’ দাবিতে উঠলেও মূল উদ্দেশ্য আসন্ন সিটি নির্বাচনে মেয়র আইভীর নৌকার মনোনয়ন (নমিনেশন) ঠেকানো। বিষয়টি আরও একবার প্রমাণ হয়েছে, শুক্রবার দেবোত্তর সম্পত্তি জিউস পুকুর রক্ষার দাবিতে ব্যানার হাতে নিয়ে হিন্দু নেতাদের আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশের মধ্য দিয়ে।
আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র আইভীকে নমিনেশন না দিতে আহ্বান জানান অরুন কুমার দাস। এমনকি নমিনেশন দিলেও নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
শিখন সরকার শিপন বলেন, আমরা হিন্দু সম্প্রদায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করবো। আইভীকে নমিনেশন দেওয়া হলে আমরা ভোট বর্জন করবো। পরিষ্কার হিসাব।
উল্লেখ্য, এর আগেও দুদকে মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের কয়েক মাস পূর্বে ২০১৫ সালের এপ্রিলে সিটি মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সংসদে বক্তব্য রাখেন সাংসদ শামীম ওসমান। ওই সময় আইভীর বিরুদ্ধে পঞ্চবটিতে পার্ক নির্মাণ, দোকান ও ফ্ল্যাট বরাদ্দের অনিয়মসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। তবে মেয়রের বিরুদ্ধে সাংসদের উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে ২০১৭ সালের অক্টোবরে তা পরিসমাপ্ত করে দুদক। মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনিয়মের কোনো প্রমাণই পায়নি দুদক।









Discussion about this post