‘শহরের চাষাড়াস্থ রাইফেল ক্লাবের সামনেই শামীম ওসমানের নাকের ডগায় অবৈধ স্ট্যান্ড, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাড়ি থেজে বের হতেই ডায়মন্ড সিনেমা হলের সামনে তার নাকের ডগায় এবং সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়রের আফরোজা ভিভার বাড়ির সামনেই জিমখানাতে তারই নাকের ডগায় অবৈধ স্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজির লংকাকান্ড চলছে অবিরামভাবেই । তাহলে আর এই অপরাধীদের ঠেকাবে কে ?’ এমন মন্তব্য নগরবাসীর
নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর সর্বত্র অবৈধ স্ট্যান্ডের ছড়াছড়ি। চালকদের শৃঙ্খলায় রাখার নামে এসব অবৈধ স্ট্যান্ডে প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি চালাচ্ছে কয়েকটি চক্র। প্রভাবশালীদের নামকরে মাসে অন্তত ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রগুলো।
এছাড়া, সড়কে নতুন ইজিবাইক নামানো বাবদ এককালিন আরো প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব চক্রের নেপথ্যে যেমন রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, তেমনি রয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তাসহ বিশেষ পেশার লোকজনও।
ইতিপূর্বে সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী এর বিরোধীতা করলেও অদৃশ্য কারণে মিলছে না প্রতিকার। কেবল খবরের কাগজে শিরোনাম হলেই ক্ষনিক সময়ের জন্য দেখা যায় প্রশাসনের তোড়জোর। তবে, সময়ের ব্যবধানে আবারও ভেসে উঠে সেই পুরনো চিত্র।
সরেজমিনে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ শহরেই সিএনজি, ইজিবাইক ও লেগুনার অবৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে প্রায় ১০টি। এই অবৈধ স্ট্যান্ডগুলো শহরের দেওভোগ ডায়মন্ড হল চত্তর, চাষাঢ়া খাজা মার্কেট সংলগ্ন নবাব সলিমুল্লা রোড, চাষাঢ়া সুগন্ধা বেকারী, চাষাঢ়া শহীদ মিনার, সরকারী মহিলা কলেজ, রাইফেল ক্লাব, ১নং রেল গেট, ২নং রেল গেট, মন্ডলপাড়া ও জিমখানা এলাকায় অবস্থিত। এছাড়া শহরের বাইরেও রয়েছে অর্ধশত অবৈধ স্ট্যান্ড। এসব অবৈধ স্ট্যান্ডের চালকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ টাকা!
শহরের দেওভোগ আলী আহমদ চুনকা সড়কের ডায়মন্ড হল চত্তর থেকে ভোলাইল মিষ্টির দোকান পর্যন্ত চলাচল করছে অন্তত ৩শ ইজিবাইক। এই সড়কটি নিয়ন্ত্রণ করছে দেওভোগ এলাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগেরই একটি পক্ষ।
আর মালিক সমিতির নামেও অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও নতুন নয়। চালকরা বলছেন, এর সাথে জড়িত রয়েছে দেওভোগের গ্যারেজ মালিক বাবুল, সোহেল, সেলিম ও বিপ্লব সহ তাদের সহযোগিরা।
গতকাল সরেজমিনে চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ইজিবাইক সড়কে নতুন নামাতে হলে এককালিন দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। চালকদের ভাষায় এটা ভর্তি ফি। এছাড়া প্রতিটি ইজিবাইক থেকে দৈনিক উত্তোলণ করা হচ্ছে ৫০ টাকা করে।
সে হিসেবে ওই রুটে চলাচলের ভর্তি ফি স্বরুপ ৩শ ইজিবাইক থেকে ১০ হাজার টাকা করে উত্তোলণ করা হলে এর সমষ্টিগত অংক দাঁড়ায় ৩০ লাখ টাকা! এছাড়া দৈনিক ৫০ টাকা করে নেয়া হলে ৩শ ইজিবাইক থেকে উত্তোলণ করা হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা।
মাসে এর অংক দাঁড়ায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা !
জানা গেছে, এই সড়ক নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে ভলেন্টিয়ার রয়েছে ৩ জন। বেতন স্বরুপ মাসে ১৫ হাজার টাকা করে দেয়া হলেও ৩জন ভলেন্টিয়ারে সর্বোচ্চ ব্যয় হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকা। বাকি ৪ লাখ ৫ হাজার টাকা উত্তোলণ করা হচ্ছে অতিরিক্ত। মাসের পর মাস এই অতিরিক্ত টাকা চলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের পকেটে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ইজিবাইক মালিক সমিতির পক্ষ থেকে মো. বাবুল গণমাধ্যম কে বলেন, ‘এই সড়কে ৩শ নয় ১০০ থেকে ১২টি ইজিবাইক চলছে। আর চালকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয় না। এটা ভুল তথ্য। আমরা মালিকরাই ৫০ টাকা জমা কম নিয়ে সমিতি করেছি। ওই ৫০ টাকা সমিতিতে যোগ হচ্ছে যা দিয়ে লাইনম্যানদের বেতন দেয়া হয়।’
অন্যদিকে, শহরের চাষাঢ়াস্থ খাজা মার্কেট ও সুগন্ধা বেকারী এবং রাইফেল ক্লাবের সামনে অবস্থিত পৃথক তিনটি লেগুনা স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রন করছেন পরিবহন নেতা মোক্তার ও তার সহযোগি দিদার হোসেন। এই তিনটি স্থান মিলিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক লেগুনা রয়েছে। দৈনিক ২০০ টাকা করে ১৫০টি লেগুনায় উত্তোলণ হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। মাসে এর অংক দাঁড়ায় ৯ লাখ টাকা।
যদিও তা অস্বীকার করছেন পরিবহন নেতা দিদার হোসেন। তিনি বলেন, লাইন নিয়ন্ত্রণের জন্য করোনার আগে চাঁদা উত্তোলণ করা হতো। কিন্তু র্যাব-পুলিশের অভিযান ও করোনার মধ্যে যান চলাচল সীমিত হয়ে উঠায় লাইনের জন্য টাকা উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। আর আদমজী লাইনের লেগুনা গুলো আরো আগে থেকেই আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
অথচ এই দিদার হোসেন সামান্য দিনমজুর থেকে জিপির নামে চাঁদাবাজি বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক ।
তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক লেগুনা চালক বলেন, আগে রাস্তা থেকেই লাইনম্যানরা টাকা উঠাতো। এখন মালিকদের কাছ থেকে অনেকটা নিরবেই উত্তোলন করা হচ্ছে চাঁদা।
এদিকে, পরিবহন নেতা মোক্তার হোসেনের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যদিকে, চাষাঢ়াস্থ সরকারী মহিলা কলেজের সামনে চাঁদা উত্তোলন করছে নুরুল ইসলাম নামে একটি চক্র।
ওই চক্রটিও নারায়ণগঞ্জ অটোরিক্সা চালক ইউনিয়ন (রেজিঃ নং- ৩৫৬১) এর অন্তর্ভূক্ত। চাষাঢ়া থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত চলাচল করা ৮০টি সিএনজি থেকে দৈনিক ৫০টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করছে নুরুল ইসলাম গ্রুপ।
এর নেপথ্যে রয়েছে প্রসিদ্ধ পরিবহন চাঁদাবাজ রিপন। অনেকটা আড়ালে থেকেই সেক্টরটি নিয়ন্ত্রন করা হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে, ৮০টি সিএনজি থেকে দৈনিক ৫০ টাকা করে মোট ৪ হাজার টাকা উত্তোলণ করা হয়।
মাসে এর অংক দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর থেকে কিছু অর্থ লাইনম্যানকে দেয়া হলেও সিংহ ভাগই চলে যাচ্ছে ওই কথিত শ্রমিক নেতাদের পকেটে।
অন্যদিকে, শহরের মন্ডলপাড়াস্থ জিমখানা সড়ক মেইন রোড বেবী টেক্সী স্ট্যান্ড ইজারা নিয়েছেন আজহারুল হক দোলন নামে এক ব্যক্তি। টোলহার ট্রিপ প্রতি ১৫ টাকা করে।
কিন্তু বেবী টেক্সী স্ট্যান্ড ইজারা নিলেও মন্ডলপাড়ার ২টি সড়কে অবৈধ ভাবে বসানো হয়েছে ইজিবাইকের স্ট্যান্ড। ওই স্ট্যান্ড থেকে দুটি রুটে চলছে ইজিবাইকগুলো। একটি হলো জিমখানা টু হাটখোলা অপরটি জিমখানা টু ডিক্রিরচর।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওই দুই লাইনে চলাচল করছে প্রায় ৩শ’টি ইজিবাইক। চালকদের মধ্যে কেউ বলছেন দৈনিক ১০০ আবার কেউ কেউ বলছেন দৈনিক ৫০ টাকা করে উত্তোলণ করা হচ্ছে। তবে, ৫০ টাকা করে ধরা হলেও ৩শ ইজিবাইকে দৈনিক উত্তোলণ করা হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। মাসে এর অংক দাঁড়ায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, ইজাদার আজহারুল হক দোলনের নাম ব্যবহার করে একটি প্রভাবশালী চক্র ওই সেক্টরটি নিয়ন্ত্রণ করছে নারায়ণগঞ্জ অটোরিক্সা চালক ইউনিয়ন (রেজিঃ নং- ৩৫৬১) নামক শ্রমিক সংগঠনের মন্ডলপাড়া আঞ্চলিক পরিচালনা কমিটির সভাপতি সৈয়দ মো. মন্তাজ আলী এবং সাধারণ সম্পাদক মো. শামীম মিয়া। ওই স্থানে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করছে লাভলু ও আকাশ নামে দুই ব্যক্তি।
চাঁদা উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে লাইনম্যান লাভলু বলেন, ‘এর সাথে আরো অনেক লোকই জড়িত আছে। তাছাড়া, শৃঙ্খলা রাখতে হলে লাইনম্যান প্রয়োজন। একজন লোক সারাদিন মাঠে কাজ করলে তার পারিশ্রমিকতো দিতে হবে। এই জন্যই চালকদের কাছ থেকে টাকা উত্তোলণ করা হয়। কোন জোরজবস্তি করা হয় না। চালকরা নিজেদের ইচ্ছেতেই দেয়।’
তবে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ইজিবাইক চালক সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা দৈনিক ১০০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে। কাশিপুরেও কয়েকজন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আছে। তাদেরকে টাকা দিতে হচ্ছে। বাধ্য হয়েই দিই, না দিলেতো এই রুটে গাড়িই চালাতে পারবো না। টাকা না দিয়ে উপায় নেই।’
এমন চাঁদাবাজির বিষয়ে আজহারুল হক দোলন নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট কে বলেন, ‘আমার সাথে ইজি বাইকের কোন সর্ম্পক নাই, যে অভিযোগ টা আমাদের বিরুদ্ধে উঠেছে এটা সর্ম্পন মিথ্যা ও বানোয়াট ইজি বাইকের চাদাঁ কে বা কাহারা আদায় করে একটু তদন্ত করে দেখুন থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে।’
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ ১নং রেল গেটেও দীর্ঘদিন যাবত গড়ে উঠেছে সিএনজি স্ট্যান্ড। ওই স্ট্যান্ডে অন্তত ৫০টি সিএনজি চলাচল করে। সিএনজি প্রতি দৈনিক ৫০ টাকা করে মোট ২ হাজার ৫শ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন হয়। মাসে এর অংক দাঁড়ায় ৭৫ হাজার টাকা। এই টাকা চলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ অটোরিক্সা চালক ইউনিয়ন (রেজিঃ নং- ৩৫৬১) এর জেলা নেতৃবৃন্দদের হাতে।
তবে, সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জুলহাস উদ্দিন বলেন, ‘১নং রেল গেটের সিএনজি স্ট্যান্ডটি সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা নেয়া। রুবেল নামে এক ব্যক্তি ইজারাদার। তাকে তার ইজাদার অর্থ প্রদান করে সামান্ন কিছু যা থাকে, তা লাইনম্যানদের দেয়া হয়, এবং শ্রমিক নেতারা নেয়।’
শহরজুড়ে এমন অবৈধ স্ট্যান্ড ও সেখান থেকে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজীর বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোঃ জায়েদুল আলম গণমাধ্যম কে বলেন, ‘অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেমন সিটি করপোরেশন যদি আমাদের কাছ থেকে সহায়তা চায়, তাহলে আমরা সহায়তা প্রদান করবো।
মূলত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ শহরে বৈধ স্ট্যান্ডই নেই। এছাড়া চাঁদা উত্তোলনের বিষয়ে লিখিত কোন অভিযোগ পেলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’
এমন অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ স্ট্যান্ড নিয়ে নগরবাসীর অভিজ্ঞজনদের অনেকেই বলেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রভাবশালী মেয়র, সংসদ সদস্য ও প্যানেল মেয়রের নাকের ডগায় অবৈধ স্ট্যান্ড বছরের পর বছর টিকে আছে কি করে তা কি নগরবাসীর কেউ জানেন না ?
নারায়ণগঞ্জবাসী কি অন্ধ ? কারা, কিভাবে এবং কার কার শেল্টারে এমন অবৈধ কর্মকাণ্ড চালচ্ছে তা সকলে জেনেও কিছু বলতে পারছেন না শুধু ধিক্কার জানানো ছাড়া ।









Discussion about this post