প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে । সকাল থেকেই সারাদেশে এক যোগে শুরু হয়েছে শিক্ষার্থীদের বরণ করার উৎসব । এ যেন এক শিক্ষার্থীদের কাছে ভিন্ন অনুভূতি।
রোববার (১২সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই এ রিপোর্ট লেখাকালীন সময়ে বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে বিশাল এক আনন্দের চমক । সকাল ৮ টা ৩৪ মিনিটে রাজধানীর ডেমরা এলাকার সামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজ ক্যাম্পাসে সরজমিনে উপস্থি হয়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা কোলাকোলি কিরছে পরম আনন্দের সাথে । এ যেন এক মিলন মেলা । এমন আনন্দের মাঝে প্রশ্ন করতেই একজন শিক্ষার্থী জানান, “অজানা আতংক থেকে শিক্ষা জীবনে আবার ফিরে এস বন্ধুদের পাবো, এ যে কি আনন্দের ! আপন ভূবনে ফিরে এসেছি, কি বলবো, ভাষা পাচ্ছি না” বলেও মন্তব্য করেন কয়েকজন কলেজ শিক্ষার্থী ।
শিক্ষার্থীদের বরণ করতে প্রস্তুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ধীরে ধীরে পড়ালেখায় অভ্যস্ত করার পরামর্শ বিশেজ্ঞদের। স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ।
নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানীর সীমান্তবর্তী এলাকায় সামসুল হক খান স্কুল এন্ড কলেজ । গতকাল শনিবার দুপুর। কয়েকজন ছাত্র ঢাকঢোল বাজাচ্ছে। এরা বিদ্যালয়ের স্কাউট দলের সদস্য। আজ রোববার এই বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ক্লাস করতে আসবে। তাদের স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এই শিক্ষার্থীরা। পরিচ্ছন্নতাসহ বিদ্যালয় খোলার বাকি প্রস্তুতি তদারক করছেন প্রধান শিক্ষক / শিক্ষিকাগণ। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে বরণ করতে প্রস্তুত তিনি। শিক্ষার্খীদের স্বাগত জানাতে স্কুল এবং কলেজের পৃথক ক্যাম্পাসে নেয়া হয়েছে নানা আয়োজন । রঙ -বে- রঙ এর বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো ভবন । তোরণ তৈরী করা হয়েছে উৎসবের আদলে ।
দীর্ঘ ১৮ মাস পর আজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলেছে। চলমান করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতির অবসান ঘটবে আজ। অপেক্ষার পালা শেষে প্রাণহীন শিক্ষাঙ্গনে আবার প্রাণের ছোঁয়া লাগছে।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ খুললেও শুরুতে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস হবে। অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে এক দিন ক্লাস করতে হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে যেদিন যে শ্রেণির ক্লাস থাকবে, সেদিন ওই শ্রেণির সর্বোচ্চ দুটি ক্লাস হবে। প্রাথমিকে হবে দিনে তিনটি করে ক্লাস। প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে সশরীর ক্লাস বন্ধ থাকবে।
দেশে গত জুলাই-আগস্ট মাসের তুলনায় করোনা সংক্রমণ অনেক কমেছে। কিন্তু সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও কেউ করোনার ঝুঁকিমুক্ত নয়। সেই আশঙ্কার সঙ্গে আছে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে সৃষ্ট জড়তাও। আর্থিকসহ নানা কারণে অনেক স্কুলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কাও আছে। তাই শিক্ষাবিদেরা বলছেন, শুরুতেই যেন পড়াশোনা নিয়ে বেশি চাপ দেওয়া না হয়। আনন্দঘন পরিবেশে সবাইকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনাই বড় কাজ। তারপর তাদের ধীরে ধীরে শিক্ষার পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।
সন্তানেরা সব মা-বাবার আবেগের অংশ। তাঁরা চান সন্তান স্কুলেও ফিরুক। আবার এই ফেরা যেন নিরাপদ হয়, তা নিয়েও তাঁদের চিন্তা আছে। এই জায়গায় এসে জনস্বাস্থ্যবিদেরা স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন। সেখানে স্কুলের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সচেতনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সরকারের ভাবনটা জানা গেল শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির কথায়। গতকাল জামালপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হবে। তারপরও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়, সেটা করতেও দ্বিধাবোধ করা হবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সারা দেশে দেড় লক্ষাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় পৌনে দুই কোটি ছাত্রছাত্রী। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির কিছু বেশি। আর কলেজে মোট শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধকোটি। বাকি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি যুক্ত।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রথম কাজটি হতে হবে সব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনা। তারপর বিদ্যালয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। এ জন্য সবার আগে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে পড়াশোনায় অভ্যস্ত করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার এই কার্যক্রমে শিক্ষা প্রশাসনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগকেও একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে যেসব বার্তা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুবই ভালো। কিন্তু এগুলো যথাযথভাবে মানতে হবে। আর শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের করোনা পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক করোনার পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে ১২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।









Discussion about this post