নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট :
নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষস্থানীয় নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন সানি ভারতে পলাতক প্রায় ছয় বছর। সেখান থেকেই বিভিন্ন গোপন অ্যাপসে নির্দেশনা দিচ্ছে মোস্ট ওয়ান্টেড এই জঙ্গি। সে অনুযায়ী বাংলাদেশে জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তার অনুসারীরা।
গত রবিবার রাজধানীর ভাটারা থেকে জেএমবি নেতা আবু রায়হান মাহমুদ ওরফে আবদুল হাদীকে গ্রেপ্তারের পর এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের কর্মকর্তারা। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন,
রায়হানের সঙ্গে সালেহীনের নিয়মিত যোগাযোগ হতো কয়েকটি গোপন অ্যাপসে। সালেহীনের নির্দেশ ও পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশে জেএমবিকে সংগঠিত করার কাজ করছিল রায়হান।
২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে জেএমবি সদস্যরা। ছিনিয়ে নেয় প্রিজনভ্যানে থাকা সালেহীন, বোমা মিজানসহ তিন জঙ্গিকে। এর পরই সালেহীন ও মিজান ভারতে পালিয়ে যায়। গত বছরের আগস্টে ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেপ্তার হয় মিজান। কিন্তু সালেহীন এখনো অধরা।
২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালেহীন ভারতের কোথায় আছে তা জানে না বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট এ লক্ষ্যে জোরালো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, রবিবার রাজধানীর ভাটারা থেকে গ্রেপ্তার রায়হান সালেহীনের শ্যালক। সালেহীনই ২০১৭ সালে রায়হানকে জেএমবির বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের আমির ঘোষণা করে। তাকে বেশকিছু দায়িত্বও দেয়।
সূত্র জানায়, অ্যাপসের মাধ্যমে রায়হানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আসছিল সালেহীন। কীভাবে জেএমবিকে সংগঠিত করতে হবে, অর্থ জোগাড় ও দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল সে। কিন্তু কোথা থেকে সালেহীন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে এখনো মুখ খোলেনি রায়হান।
ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে পালানোর পর সালেহীনকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ সদর দপ্তর। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ তাকে মোস্ট ওয়ান্টেড ঘোষণা করে। গণমাধ্যমের খবর, ভারতে গিয়ে এই জঙ্গি পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির নতুন শাখা খোলে। যার নাম-জামাআতুল মুজাহিদিন ইন্ডিয়া (জেএমআই)।
২০১৪ সালের অক্টোবরে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বিস্ফোরণে দুজন নিহত হয়। এর পর ভারতের এনআইএ সালেহীন ও বোমা মিজানের খোঁজ করতে থাকে। বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গেও তারা দফায় দফায় তথ্য বিনিময় করে। ফলে গত বছর মিজান গ্রেপ্তার হয় ভারতে। দেশটির আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জেএমবির এক সময়ের শূরা কমিটির সদস্য সালেহীনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বলে জানা গেছে।
গত বছর সালেহীনকে উদ্ধৃত করে হিন্দুস্তান টাইমস এ
একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে বলা হয়, ‘ভারত যাতে হিজরত আর জিহাদের একটি কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়, সে জন্য আমরা কাজ করছি, যাতে ভারতের মানুষ নতুন খিলাফতের ভিত্তি গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
২০০৫ সালে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় সালেহীনের বিরুদ্ধে ৪০টির বেশি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৩ মামলায় তার সাজা হয়। তিনটিতে হয় মৃত্যুদণ্ড।

কে এই সালেহীন
জেএমবির শুরুর দিকের শুরা সদস্য এই সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলামের ছেলে।
দেশের বিভিন্ন থানায় সালেহীনের বিরুদ্ধে ৪০টির বেশি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ মামলায় তার সাজার রায় হয়েছে, এর তিনটিই হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
১৯৯৭ সালে বন্দর বিএম ইউনিয়ন স্কুল থেকে পাস করে সালেহীন ভর্তি হন ঢাকার তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। তখন তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী। ওই সময় থেকেই পরিবার থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকেন, এক পর্যায়ে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গিবাদে।
২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর নিম্ন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সালেহীন নিজের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এর মধ্যে দিয়ে জেএমবির সূচনা এবং এর বিস্তার সম্পর্কে মোটামুটি স্পষ্ট একটি ধারণা পায় পুলিশ।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সালেহীন বলেন, “১৯৯৯ সালে বেনামে বাসাবোর কদমতলায় একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। শায়খ আব্দুর রহমান, আমি, হাফেজ মাসুদ, শাহেদ ও রানা প্রথম মজলিসে শুরার সদস্য হই। পরে শাহেদ ও রানা দল ত্যাগ করলে সেখানে অন্য দুইজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০১ সালে এই সংগঠনটি কাঠামো দিয়ে নাম রাখা হয় ‘জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’।
সালেহীন আদালতে বলেন, ২০০১ সালের পর কাজের সুবিধার্থে সারা দেশকে তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। তিনি পান ঢাকার উত্তর অঞ্চল তথা ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের দায়িত্ব। পরে ২০০২ সালে সিলেটের দায়িত্বও তাকে দেয়া হয়।
ওই সময় জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি থানার সানা কৈর গ্রামে হৃদয় রায় নামে এক তরুণকে হত্যা করেন সালেহীন ও তার সহযোগীরা। বরিশালের ছেলে হৃদয় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে একটি মিশনের হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে অভিনয় করে যিশুর জীবনকাহিনী তুলে ধরতেন- এটাই ছিল তার ‘অপরাধ’।
ওই মামলায় ২০১৩ সালে হাই কোর্টের রায়ে সালেহীনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। গনি গোমেজ নামে আরেক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানকে হত্যার দায়ে হাই কোর্ট সালেহীনসহ দুই জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় একই বছর।
আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হলেও তার বিরুদ্ধে আপিল করেননি সালেহীন। বরং তিনি দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।









Discussion about this post