লকডাউনের কারণে সংসার আর নিজের চিকিৎসা নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন ফরিদ উদ্দিন। এমন পরিস্থিতি ৩৩৩ নম্বরে প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য খাদ্য সহায়তা পাওয়ার আশায় ফোন করাটাই যেন কাল হলো তার। দুই বাড়ি পাশে থাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এ কারণে। উপজেলা পরিষদ থেকে তদন্তে আসা লোকদের বলে দিয়েছেন ফরিদ উদ্দিন একজন ব্যবসায়ী এবং চারতলা বাড়ির মালিক।
সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের বিনাভোটে নির্বাচিত সদস্য নানাভাবে বিতর্কিত আইয়ুব আলীর এমন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাজির হয়ে ১০০ দরিদ্রকে ত্রাণ দিতে বলেছিলেন ফরিদ উদ্দিনকে।
এই ত্রাণের টাকা যোগাড় করতে নিজের আর ভাইয়ের স্ত্রীর স্বর্ণালংকার বন্ধক দিতে হয়েছে তাকে। কষ্টে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নাগবাড়ি শেষ মাথা এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নিয়মিত এফএম রেডিও শোনেন তিনি। রেডিওতে সংবাদে তিনি জেনেছেন ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা পাওয়া যায়। সরকারি সহায়তা পেতে তিনি কল করেছিলেন ওই নম্বরে। কিন্তু সহায়তা তো পাননি, উল্টো তিনি চারতলা ভবনের মালিক এমন তথ্যের কারণে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে তাকে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরার নির্দেশে তাকে ১০০ জনের মাঝে চাল, আলু, ডাল, লবন ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে হয়েছে।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, তার আর্থিক অবস্থা খুবই করুণ। কাজ করতে পারেন না। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্য মেয়ে টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগান। প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য নিয়মিত ওষুধ লাগে। তার নিজেরও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। দুই চোখেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তিনবার স্ট্রোক করেছেন। কোনো রকমের সঞ্চয় নেই তার। নিজের ওষুধ কেনারও পয়সা নেই। ছয় ভাই ও এক বোন মিলে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে চারতলা ভবন করেছেন। চারতলায় উপড়ে টিন শেড দেওয়া দু’টি ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন ফরিদ। নিজে অসহায় অবস্থায় পড়েছেন বলেই সরকারি সহায়তার জন্য ওই নম্বরে কল করেছিলেন বলে জানান এই বৃদ্ধ। সহায়তা চেয়ে আরও বিপদে পড়েছেন তিনি। ১০০ জনকে খাদ্য সামগ্রী দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই। নিজের স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর গয়না বিক্রি ও ধার-দেনা করে বিতরণের জন্য এসব খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন বলেও জানান। এমনকি স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর থেকেও ধার নিয়েছেন ১০ হাজার টাকা।
ফরিদ উদ্দিনের ছোট ভাই শাহীন ও আরেক ভাইয়ের স্ত্রী বিলকিস বেগমও সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো না। চারতলায় টিনশেডের দু’টো ঘরই তার সম্বল। অথচ তাকে চারতলা বাড়ির মালিক বলে জরিমানা করেছেন ইউএনও। বিলকিস বলেন, ‘১০০ জনের খাবার কেনার টাকা কই পাবেন আর না দিতে পারলে জেল হবে, এই লজ্জায় শুক্রবার রাতে দুইবার আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন আমার ভাসুর। মেয়েটা অবিবাহিত তাই লোকলজ্জার ভয়ে গয়না বিক্রি, ধানদেনা করে ৭০ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন।’
শনিবার ২২ মে খাদ্যসামগ্রী বিতরণের সময় উপস্থিত ছিলেন ইউএনও আরিফা জহুরা, সদরের এসিল্যান্ড হাসান বিন আলী, কাশীপুর ইউপি’র ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আইয়ুব আলীসহ স্থানীয় এলাকাবাসী।
এ সময় বিতরণ করা প্রতি প্যাকেটে সরকারি সহায়তার মতো ৫ কেজি চাল, ১ কেজি করে আলু, ডাল, সয়াবিন তেল, লবন ও পেয়াজ ছিল। এসব খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার সময় ইউএনও’র সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফরিদ উদ্দিন ও তার পরিবারের লোকজন।
তারা জানান, ধার-দেনা করে তারা এই খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন। তাদের পারিবারিক অবস্থা অস্বচ্ছল ছিল বলেই ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন। তারা চারতলা ভবনের মালিক না।
এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ফরিদ উদ্দিন একজন হোসিয়ারি ব্যবসায়ী, চারতলা বাড়ির মালিক। সে কেন ৩৩৩ নম্বরে ফোন দেবে ? আর খাবারের দরকার হলে আমাকে বলতো, আমি স্থানীয় মেম্বার। এটাতো আমার জন্য ‘ডিসক্রেডিট’।
মাত্র দুই বাড়ি পরে থেকেও ফরিদ উদ্দিন প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে কষ্টে আছেন এমনটি জানলেন না কেন- এমন প্রশ্ন করার পর নিজের বক্তব্য তাৎক্ষণিক ঘুরিয়ে ফেলেন আইয়ুব আলী। তিনি বলতে শুরু করেন, আমি ইউএনও ম্যাডামকে বলেছিলাম ১০ লোককে ত্রাণ দেওয়ার অবস্থা ফরিদের নেই। কিন্তু ততক্ষণে কিছুই করার ছিল না।
অপরদিকে উপজেলা পরিষদের লোকজন তদন্তে আসার পর চারতলার বাড়ির মালিক কেন বলেছেন- এমন প্রশ্ন করলে আইয়ুব আলী উত্তর না দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ‘বাড়ি থেকে শরবত বানিয়ে এনেছি, খান’ বলে সটকে পড়েন।
বিষয়টি নিয়ে ইউএনও আরিফা জহুরার কার্যালয়ে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার ৩৩৩ কল সেন্টারের মাধ্যমে অসহায় ও দুস্থদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কেউ ওই নম্বরে কল করে সংকটের কথা জানালে ইউএনও অফিসে জানানো হয়। পরে তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে যাচাই করে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ফরিদ উদ্দিনের বিষয়টি স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীই প্রথম তথ্য দিয়েছিলেন যে তিনি চারতলা বাড়ির মালিক। পরবর্তীতে আমি যাচাই করতে নিজেই বৃহস্পতিবার সেখানে যাই। ফরিদ উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে ওই বাড়ির মালিক তিনি এবং ৩৩৩ এ ফোন দিলে খাদ্য সহায়তা দেয় কিনা দেখতেই তিনি ফোন দিয়েছিলেন।
ফরিদ উদ্দিনের বাড়ির পাশেই স্থানীয় ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর বাড়ি। তিনি ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক অবস্থার কথা জানতেন। যেদিন ইউএনও তাকে ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইয়ুব আলী। তিনি কেন ইউএনও’কে সঠিক তথ্য জানালেন না । ইউপি সদস্য আইয়ুব আলীর প্রতি এমন প্রশ্ন ছিলো এলাকাবাসীর ।
আইয়ুব আলী সাংবাদিক ও এলাকাবাসী প্রশ্নের মুখে সটকে পরলে উপস্থিত অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যে ব্যক্তি টানবাজার পতিতাপল্লীতে নানা কেলেংকারীতে জড়িত । তার কাছ থেকে এর চাইতে ভালো কিছু আশা করাই তো ভুল । এমন ব্যক্তি ই তো বিনা ভোটের মেম্বার ।
পতিতাপল্লীর নানা কেলেংকারীসহ আইয়ুব আলীর সম্পর্কে এলাকাবাসী বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেছেন । যার রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট এর দপ্তরে
সহায়তা চাওয়া ফরিদ উদ্দিন সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল ছিল কিনা এবং লঘু পাপে তিনি গুরুদন্ড পেলেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে এসব খোঁজখবর নেওয়া হয়। ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী তাকে ফরিদ উদ্দিনের আর্থিক স্বচ্ছলতার তথ্যই দিয়েছিলেন। এমনকি সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়েও তিনি একই তথ্য পেয়েছেন বলেই ওই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে যেহেতু তার আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টি সামনে এসেছে সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই করবেন বলেও জানান আরিফা জহুরা।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ফরিদ উদ্দিন যদি সত্যিই অসহায় হয়ে থাকেন তাহলে তাকে সহযোগিতা করা হবে। ত্রাণ সহায়তা দিতে তার যে খরচ হয়েছে সেই অর্থও তাকে ফেরত দেওয়া হবে। দুইদিন সময় পাওয়ার পরও তারা কেন প্রশাসনকে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানাননি সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।









Discussion about this post