সোনারগাঁয়ে রিসোর্ট কান্ডে হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মামুনুল হকের এক ডাকে হুমরি খেয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে লংকাকান্ড ঘটানোসহ ধর্মীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যুতে নারায়ণগঞ্জের সড়কে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের।
কিন্তু ১৮ মে মংগলবার সকালে সেই মামুনুল হককে ধর্ষণ মামলাসহ অন্যান্য মামলায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাশিমপুর কারাগার থেকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আনা হলেও সেই নেতার কোন খোজ নিতে যান নাই নারায়ণগঞ্জের বিতর্কিত সেই নেতাদের কেউ ।
মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এমন খবরের পরও চরমভাবে বিতর্কিত নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের নেতা মাওলানা আব্দুল আউয়াল, মাওলানা ফেরদৌসসহ কারো কোন খোজ পাওয়া যায় নাই ।
অথচ নারায়ণগঞ্জের এই চিহ্নিত বিতর্কিত নেতা মাওলানা আব্দুল আউয়াল, মাওলানা ফেরদৌস চক্র সাম্প্রতিক সময়ে শাসক দলের নেতাদের সাথে গোপনে আঁতাত করে শাসক দলের অপর নেতাদের কোনঠাসা করতে নানা ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে নানাভাবে প্রকাশ্যেই হুমকি ধমকি দেয় বিতর্কিত আউয়াল-ফেরদৌস চক্র।
এমন অসংখ্য ঘটনা ছাড়াও বিগত সময়ে ভিন্নমতের অনুসারীদের বিরুদ্ধে কিংবা স্থানীয় রাজনৈতিক ইস্যুতে বিশাল মিছিল নিয়ে রাজপথে হুঙ্কার দিয়েছেন হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্যালেস্টাইন তথা ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর ইসরায়েলের ইহুদিদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই ক্বওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠনটির।
এই ইস্যুতে যেন চুপসে গেছেন সংগঠনটির বাঘা বাঘা নেতারা।
তবে নেতা-কর্মীদের একটি সূত্র বলছে, হেফাজতের সাম্প্রতিক কর্মকান্ডে চাপে আছে নেতারা। শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাই সহিসংতার মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন আর বাকিরা গ্রেফতার এড়াতে পলাতক রয়েছেন। নেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়াতে দলছুট হয়ে পড়েছেন কর্মীরাও।
জেলা হেফাজতের শীর্ষ চার নেতার মধ্যে রয়েছেন জেলা হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা আব্দুল আউয়াল, সাধারণ সম্পাদক মুফতি বশিরউল্লাহ, মহানগর হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ ৷ তাদের মধ্যে মুফতি বশিরউল্লাহ সহিসংসতার মামলায় গ্রেফতার হয়ে রয়েছেন কারাগারে৷ বাকি তিনজন গ্রেফতার এড়াতে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন৷
শুরুটা হয়েছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে। এই সফরের বিরোধীতা করছিল দেশের প্রগতিশীল সংগঠনগুলো। একই সাথে আন্দোলন চালায় ক্বওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
নারায়ণগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।
গত ২৬ মার্চ এই ঘটনায় হেফাজতের কর্মী-সমর্থকরা ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিক্ষোভ করে। এ নিয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বাধে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মলবাড়িয়া ও হাটহাজারিতেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন মাদরাসা ছাত্র ও হেফাজত কর্মী নিহত হন। পরে ২৮ মার্চ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
হরতালের দিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ছিল হরতাল সমর্থকদের দখলে। তারা এই মহাসড়কে রীতিমতো তান্ডব চালায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে প্রায় ১৮টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। নির্বিচারে চলে ভাঙচুর। দফায় দফায় বিজিবি-পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
উগ্রবাদী হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীদের হামলায় ওই সময়ে পুলিশ-সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক নিরীহ মানুষ আহত হন। পুরো সময়জুড়ে সাংবাদিক উপর চড়াও ছিল হেফাজত ইসলামের আউয়াল – ফেরদৌস চক্রের সদস্যরা। হেফাজতের তান্ডবে ১২ জন সাংবাদিককে মারধর ও দু’টি মিডিয়ার গাড়ি ভাঙচুর করেছে। মহাসড়কটি ভোর থেকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত পর্যন্ত ছিল হরতাল সমর্থকদের দখলে।
পুলিশের তথ্যমতে, এই সময়ের মধ্যে ১৮টি ট্রাক, বাস, কাভার্ডভ্যানে আগুন, নির্বিচারে যানবাহনে ভাঙচুর, সাংবাদিকদের মারধর করেছে হেফাজতের পিকেটাররা। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রায় ৪০০০ রাউন্ড গুলি (রাবার, সিসা, চাইনিজ রাইফেল) ছুড়েছে পুলিশ। প্রায় এক থেকে দেড়শ কাঁদানে গ্যাসের শেলও নিক্ষেপ করা হয়।
দিনভর এই সহিংসতার ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় পুলিশ ও র্যাব বাদী হয়ে ছয়টি মামলা করে। মামলায় ১৩৬ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৩৭০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। তবে মামলায় বাদ পড়েন জেলা হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ। একই থানায় আরও তিনটি মামলা হয়।
এরপর গত ৩ এপ্রিল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়েল রিসোর্টে এক নারীসহ অবরুদ্ধ হন হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। তাকে ছাড়িয়ে নিতে ওই রিসোর্টে ভাঙচুর চালায় কর্মী-সমর্থকরা। পরে একই ঘটনার জেরেই সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আগুন দিয়ে অবরোধ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাদের অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালায় তারা। এইসব ঘটনায়ও সোনারগাঁ থানায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কয়েকটি মামলায় মামুনুল হককেও আসামি করা হয়। মামুনুলের বিরুদ্ধে তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্নাও ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন।
এইসব মামলায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতার আছেন মাওলানা মামুনুল হকও। নারায়ণগঞ্জ জেলার শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মীদের নামও এইসব মামলায় জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের অনেকেই রয়েছেন এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে আবার অনেকেরই রয়েছেন শাসক দলের প্রভাবশালী নেতাদের শেল্টারে ।
যারা প্রকাশ্যে রয়েছেন তারাও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছেন না। ফিলিস্তিনে বর্বর হামলার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট করেছে। তবে নিশ্চুপ রয়েছে ধর্মীয় ইস্যুতে নিজেদের সবসময় আগ্রগামী প্রমাণ করার প্রয়াসে থাকা হেফাজতে ইসলাম। এই সংগঠনটি এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি রাখেনি এই ইস্যুতে।
এ বিষয়ে কথা বলতে জেলা হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা আব্দুল আউয়াল ও মহানগর হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের নম্বরে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আব্দুল আউয়াল কলটি রিসিভ করেননি অন্যদিকে ফেরদাউসুর রহমানের মুঠোফোনের নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের একাধিক সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডে তাদের নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ মামলায় গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।শাসক দলের কোন কোন নেতা এতোদিন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে শহরের ডিআইটি মসজিদের বিতর্কিত খতিব মাওলানা আব্দুল আউয়াল ও মাওলানা ফেরদৌস কে ব্যবহার করে নগরীতে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মদদদাতারাও বর্তমান প্রেক্ষাপটে পিছপা দিয়েছে নিজেদের স্বার্থেই । ফলে বিতর্কিত আউয়াল -ফেরদৌস চক্র গাঢাকা দিয়েছেন গ্রেফতার এড়াতে ।









Discussion about this post