১৭ বছর আগে নৃশংস সেই গ্রেনেড হামলার ঘটনায় রতনের মৃত্যুর পর পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার । ঠিকমতো তখন খোঁজখবরও নেয়নি আওয়ামী লীগের লোকজন। এখন কিছুটা পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও কান্না থামেনি রতনের পরিবারের লোকজনের। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকালে শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালীন গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পথেও সঙ্গীদের কাছে রতন বারবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমার নেত্রী বেঁচে আছেন তো’। একথা বলতে বলতে এক সময়ে ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
‘বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রচণ্ড পছন্দ ও ভালোবাসতেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার গাবতলী এলাকার রতন শিকদার। শেখ হাসিনা ভাষণ দেবেন খবরটি জানলেই নাওয়া-খাওয়া আর রুটি-রোজগার ভুলে চলে যেতেন ভাষণ শুনতে। ভাষণ শেষে রাতে বাড়ি ফিরে সেই গল্পও করতেন। তবে সবশেষ গল্পটি আর পরিবারের কাছে বলা হয়নি তার। ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন রতন।
‘মাগো আজ আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো, তুমি কোনো চিন্তা করো না’। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দুপুরে মাকে এ কথা বলেই বাড়ি থেকে বের হয়েছিল বঙ্গবন্ধু, তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ ভক্ত রতন শিকদার।
অনেক কাজ থাকা সত্ত্বেও দল আর নেত্রীর টানে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ছুটে গিয়েছিল রতন।
কিন্তু তখনও রতন বুঝেনি না ফেরার দেশে তাকে নিয়ে যেতে অপেক্ষা করছিল ঘাতক গ্রেনেড।
একুশে আগস্টের দিনে গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারান রতন শিকদার। মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি সে। রতন ফিরেছিল লাশ হয়ে। সেদিন মাকে চিন্তামুক্ত থাকার পরামর্শ দিলেও পরিবারের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন পরপারে। দিয়ে গেছেন শোক আর কান্নার পাহাড়। পরিবারের সদস্যরা ১৭ বছর ধরে এখনো কেঁদে চলেছেন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৭ম বর্ষ শনিবার। এ দিনটি ফিরে এলেই যেন কান্না বেড়ে যায় রতনের পরিবারের।
নিহত রতনের পরিবারের আক্ষেপ ‘যে দলের নেত্রীর ভাষণ শুনতে গিয়ে সেদিন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় রতন নিহত হয়েছিলেন, সেই নেত্রীর দল এখন ক্ষমতায় থাকলেও দলের কেউ বিগত সাত বছরে পরিবারের কোনো খবর নেয়নি। ”
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা থানার গাবতলী মাজার এলাকায় বসবাস করেন রতন শিকদারের পরিবার। সেখানে তার মা ও ভাই থাকে। রতনের স্ত্রী রোজিনা আক্তার দুই সন্তান নিয়ে যাত্রাবাড়িতে তার বাবা-মায়ের সংসারে বসবাস করছেন। ছেলে আনন্দ শিকদার (১৬) ও মেয়ে অপূর্ব (৮) দু’জনই যাত্রাবাড়ি আইডিয়াল স্কুলে লেখাপড়া করে।
রতনের মা মমতাজ বেগম মুঠোফোনে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অনেকে আছে শুধু মুখে বলে আমি আওয়ামী লীগ করি, শেখ হাসিনার দল করি। কিন্তু অন্তরে নেই প্রকৃত ভালোবাসা আর টান। তারা রাজনীতি করে স্বার্থের জন্য। কিন্তু আমার ছেলে ছিল আওয়ামী লীগ প্রকৃত প্রেমিক। ’
গ্রেনেড হামলায় রতন যখন রক্তাক্ত ছিল, তার জীবন যখন চরম সন্ধিক্ষণে তখনো সে দলের প্রতি দেখিয়েছিল অগাধ ভালোবাসা। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পথেও সঙ্গীদের কাছে বার বার জিজ্ঞেস করছিল ‘আমার নেত্রী বেচেঁ আছে তো। ’ একথা বলতে বলতে এক সময়ে ঢলে পড়লো মৃত্যুর কোলে।
মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমার রতন মরেনি, ও বেঁচে আছে আমার অন্তরে। রতন কখনো মরতে পারে না। ও বেঁচে থাকবে সবার মাঝে। ’
উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে বলেছেন, ‘অনেক নেতা-ই মাইক পেলে বক্তব্যের স্ট্যান্ডবাজি শুরু করে। কিন্তু দলের জন্য বেশি ভালবাসায় আসক্ত আমার পুত্র রতন আজ ১৭ বছর হলো মারা গেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের কেউ আমার পরিবারের খবর রাখেনি। ’
মমতাজ বেগম ক্ষোভের সঙ্গে জানান, এবার মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ভেবেছিলাম অন্তত একটা গতি হবে। আমাদের খোঁজ খবর নেওয়া হবে। কিন্তু তাও হলো না।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামীলীগ আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা রতন শিখেছিল পরিবার থেকে। বাবা মৃত আবদুল হক শিকদারও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। আওয়ামী লীগের মিছিল, মিটিং বা সমাবেশ হলে তাকে ও রতনকে বেঁধে রাখা যেত না। মিছিল-মিটিংয়ের আগে থাকতেন, স্লোগান দিতেন। ক্ষুদ্র ব্যবসার স্বল্প উপার্জনে সংসার চালানো দায় হলেও শেখ হাসিনার কোনো সমাবেশ হলেই নিজের টাকা খরচ করে সেখানে ছুটে যেতেন তিনি। ’
ক্ষোভ করে তিনি বলেন, ‘২১ আগস্ট এলে সাংবাদিকরাই দৌঁড়ে আসে, আর কারো খবর থাকে না। আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার চাই। এটাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আশা। আমার চাওয়া পাওয়ার আর কিছু নেই। ’
রতনের ছোট ভাই টুটুল শিকদার সাংবাদিকেদের বলেন, ‘ভাইয়া একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন। বিভিন্ন টেক্সটাইল মিল থেকে কাপড় কিনে দোকানে বিক্রি করতেন। তিনি মারা যাবার পর আমাদের পরিবারের উপর নানা ধরনের চাপ আসতে শুরু করল। পুলিশ প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে রাজনীতি না করতে এবং মামলার ঝামেলায় না যেতে চাপ দিত। চাপের কারণে আমি বিদেশে চলে যাই। কয়েক বছর আমি আবারো দেশে ফিরে আসি। ‘আমি চাই আমার ভাই হত্যাকারীদের বিচার হোক। ’
প্রসঙ্গত ২০০৪ সালে ইতিহাসের বর্বরোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মারা যান ২২ জন আর আহত হন আরও ১২০ জন। যাদের মধ্যে নিহত একজন রতন শিকদার। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। আর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড দেয় আদালত। যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া এই ১৯ আসামির মধ্যে ১৩ জনই পলাতক ছিল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পৃষ্ঠার সংখ্যা ৩৬৪, আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় রায়ের পৃষ্ঠার সংখ্যা ৩০৭।









Discussion about this post