নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হল আজ সোমবার । এরই মধ্যে বিচারের দুটি ধাপ পার হয়েছে।
এখন এটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ নিহতদের পরিবারের সদস্যরা দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে রায় কার্যকর হোক তা চান ।
নিহতের পরিবারের এক সদস্য বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের লোকজন এখনও এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ সকল ধরণের অপরাদের সাথে জড়িত রয়েছে । নূর হোসেন ফাঁসির কনডেম সেলে বন্দি থাকলেও তার অনুসারীরা এখনো রয়েছে অপরাধীদের শীর্ষ অবস্থানে । সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়। তিনি দ্রুত রায় কার্যকর চান।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ, পরদিন ১ মে শীতলক্ষায় বেসে উঠে আরেকটি লাশ।
নিহত বাকিরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। আলোচিত এ মামলায় ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি নিম্ন আদালতের দেয়া রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ আসামি হাইকোর্টে আপিল করেন।
২০১৭ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১১ আসামিকে যাবজ্জীবন এবং বাকি ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর দুই মামলায় মোট ১৫৬৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন হাইকোর্ট ।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, র্যাব একটি এলিট ফোর্স এবং মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য এরা বহুবিধ কাজ করেছে। কিছু ব্যক্তির জন্য সামগ্রিকভাবে এই বাহিনীকে দায়ী করা যায় না।
আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায় তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে। এই খুনের ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত থাকায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে সংশয় ছিল।
মামলার রায়ে সেই সংশয় দূর হয়েছে। তবে সাত জনকে যে কায়দায় খুন করে লাশ গুম করা হয়েছে তা ছিল শিউরে ওঠার মতো।
গোটা দেশ আলোড়িত হয়েছিল। চরম সংবেদনশীল ও আলোচিত এই মামলার শেষ পরিণতি দেখার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন দেশবাসী।
অসংখ্যবার কথা হয় নৃশংসতার শিকার কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির সাথে । তিনি জানান, ঘটনার পর থেকেই আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমার ছেলে অসুস্থ। আমি নিজেও অসুস্থ। রায়ে সন্তুষ্ট হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই। তবে আদালতের প্রতি আমাদের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারোয়ার কাজল গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আপিল বিভাগেই হবে চূড়ান্ত বিচার। আপিল বিভাগে রায় বহাল থাকলে সত্যায়িত কপি যাবে সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে। এ ক্ষেত্রে আসামিরা রিভিউ (পুনঃবিবেচনা) আবেদন না করলে রায় কার্যকরের জন্য বিচারিক আদালত অনুলিপি কারাগারে পাঠাবেন। পরে কারা কর্তৃপক্ষ জেলকোড অনুযায়ী রায় কার্যকর করবেন। তবে আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ পাবেন।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত আপিল করেছেন সাজপ্রাপ্ত ১৩ আসামি । এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১০ জন এবং তিনজন হচ্ছেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হচ্ছেন- র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা নূর হোসেন, সিপাহি আবু তারিক, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক বেলাল উদ্দিন, এসআই পুর্ণেন্দু বালা, আরওজি আরিফ হোসেন, সৈনিক আল আমিন সরকার।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন হচ্ছেন- নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, জামাল উদ্দিন ও সেলিম। আরিফ হোসেন আপিল করেছেন বলে জানান তার আইনজীবী এসএম শাহজাহান।
ফাঁসির ১৫ জন আসামি
হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড আসামিরা-প্রধান আসামি নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (পলাতক), সৈনিক আলামিন শরিফ (পলাতক) ও সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক)।
যাবজ্জীবন ১১ জনের
১১ জনকে ১৬ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলেও ২২ আগস্ট হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। তারা- র্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, জামালউদ্দিন, এনামুল কবীর, সানাউল্লাহ সানা (পলাতক), শাহজাহান (পলাতক)।
কারাদণ্ড ৯ জনের
এর আগে ১৬ জানুয়ারি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে যাদের রায় ২২ আগস্ট হাইকোর্ট বহাল রেখেছে। অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। হাইকোর্ট তাদের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে।
সেই ৭ খুন : যেভাবে অপহরণ ও হত্যা
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। ৩০ এপ্রিল বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল। পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি মরদেহে ইটভর্তি দু’টি করে বস্তা বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।









Discussion about this post