আদমজী জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন মতিউর রহমান মতি। সাত খুন মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী নূর হোসেনের হাত ধরে জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন। পরে হন থানা যুবলীগের সভাপতি। এর মধ্যে টানা দুইবার সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর। সবশেষ নাসিক পরিষদে ছিলেন প্যানেল মেয়র। দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন । রয়েছে নানা অভিযোগ। সেই মতি এবার ফাঁসছেন দুর্নীতিতে।
ইতোমধ্যে ১৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মতি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
১৭ ফেব্রুয়ারি দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, প্রথম মামলায় কাউন্সিলর মতির বিরুদ্ধে ৬ কোটি ১ লাখ ৭২ হাজার ২৬৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনসহ ১০ কোটি ৮৬ লাখ ৫ হাজার ৬৩৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকে ৮২ কোটি ৫১ লাখ ৪২৪ টাকা জমা করে পরবর্তীতে ৭৪ কোটি ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৮৯ টাকা উত্তোলন করে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তর করে অবস্থান গোপন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অন্যদিকে অপর মামলার এজাহারে কাউন্সিলর মতির স্ত্রী রোকেয়া রহমানের বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৬১ লাখ ১৮ হাজার ৩৯৭ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ১ কোটি ৮৬ লাখ ৬৭ হাজার ৩৯৫ টাকা জমা করে সেখান থেকে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৯৮ টাকা উত্তোলন করে তা স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরপূর্বক অবস্থান গোপন করার অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২) ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।
নানা কারণে বিতর্কিত মতি
মতির বিরুদ্ধে রিফিউজিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া জমি জালিয়াতির মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকায় বিক্রির অভিযোগ উঠে। জালিয়াতির মাধ্যমে রিফিউজিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া জমি বিপুল টাকায় বিক্রিতে সম্পৃক্ত থাকায় মতির পাশাপাশি তার সহযোগীদের কয়েকজনের বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছে দুদক। তাদেরও কমিশনে তলব করা হবে।
মতি তার সহযোগীদের সহযোগিতায় আদমজী ইপিজেড এলাকায় রিফিউজিদের জন্য বরাদ্দ কয়েক বিঘা জমি জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে দিয়েছেন।
এছাড়া নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এলাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। কেউ তার অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে সহযোগী শাহ আলমকে বাদী করে মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। এলাকায় মতি বাহিনীর ক্যাডার হিসেবে পরিচিত আক্তার হোসেন ওরফে পানি আক্তারের মাধ্যমে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে রিফিউজিদের ওই জমি দখল করে নেন মতি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, একসময় নূর হোসেনের সহযোগী মতি ১৯৯৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি আদমজীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। গড়ে তোলেন নতুন বাহিনী। অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে মতিকে ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে। ওই সময় এক বিএনপি নেতার মধ্যস্থতায় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ থেকে বেঁচে যান তিনি। মুচলেকা দেন যে তিনি বা তার বাহিনী কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অংশ নেবে না। পরে কিছুদিন এলাকাছাড়া ছিলেন। কিন্তু বছর তিনেক বাদে এলাকায় ফিরেই সুমিলপাড়া, আমদজী ইপিজেড, সোনামিয়ার বাজার, বাগপাড়া, মন্ডলপাড়া, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাড়ৈপাড়া এবং শীতলক্ষ্যার তীর ও এর আশপাশের এলাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করে মতি ও তার সহযোগীরা।
শ্রমিক আর তেলচোর থেকে গডফাদার
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আইলপাড়া মো, বাদশা মিয়ার পুত্র এলাকার মতিউর রহমান মতি আদমজী পাট কারখানায় একজন সাধারণ শ্রমিক ছিলেন । সে সময়ে আদমজীতে একক কর্তৃত্ব ছিল আওয়ামীলীগের শ্রমিক নেতা রেহান উদ্দিন রেহান ও তার বাহিনীর। ১৯৮৯ সালে আদমজীর ব্যাপক সমালোচিত শিল্পপতি ও বিতর্কিত চলচিত্র ব্যবসায়ী সফর আলীর ভূইয়ার হাত ধরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয় মতি। মতির এ প্রভাব বিস্তার রেহান গ্রুপের সঙ্গে মতির নিয়মিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে । পরে রেহানের হাত ধরেই আওয়ামীলীগে যোগ দেয় মতি।
১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় সরকারী ত্রাণ দেওয়ার দায়িত্ব পায় মতি, জাফর ও রেহানের স্ত্রী সুফিয়া রেহান। রাতারাতি মতির ভাগ্য বদলে যায়। সে সময়ে থানা যুবলীগের আহবায়ক পদ নিয়ে অপর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারে নিহত জাফরের সঙ্গে মতির বিরোধ নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পরবর্তিতে আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে মতিকে আহবায়ক ও জাফরকে দেওয়া হয় আদমজী নগর যুবলীগের সহ-সভাপতির পদ।
২০০১ সালের নির্বাচনের আওয়ামীলীগের ভরাডুবির পর দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয় মতি। সেখান থেকে চলে যায় দুবাই। পরে প্রায় দুই বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করেন। এরই মধ্যে আদমজীর কদমতলী এলাকায় আদমজীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবলীগ ক্যাডার রগ কাটা জাফর র্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায়। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১ ডজন মামলা ছিল।
২০০৭ সালের ১৩ মার্চ ইন্টারপোল মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে। ইন্টারপোল তাদের ওয়েব সাইটে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে প্রাণনাশের হুমকি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অংশ গ্রহনের অভিযোগ তুলে। ওয়েব সাইটে তার সম্পর্কে বিবরণ দিতে গিয়ে জন্ম ১ জুলাই ১৯৭৭ সেই মতে তার বয়স ২৯ বছর, উচ্চতা ১.৭০ মিটার বা ৬৭ ইঞ্চি, ওজন ১৫৪ পাউন্ড বা ৭০ কেজি উল্লেখ করা হয়। ২০১১ সালে ওই ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
দীর্ঘ আট বছর পলাতক থাকার ২০০৯ সালের জুন মাসে দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পন করেন ওই সময়ের ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্টভুক্ত নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও থানা যুবলীগের আহবায়ক মতিউর রহমান মতি। মতির বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তিনটি হত্যা সহ ২০টি ও বিভিন্ন মামলায় আরো ৭-৮টি মামলা ছিল। বেশীরভাগ মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে মতি ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও দুবাই পলাতক ছিলেন।
আলোচিত ৭ খুনের পর ২০১৪ সালের ১৪ মে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতি মতিউর রহমান মতির বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর দীর্ঘদিন পলাতক ছিল মতি। কয়েকমাস পরে এলাকায় ফিরে সে দখল করে নেয় আদমজী ইপিজেড সহ নানা সেক্টর। ৭ খুনের শুরুতে মজিবুর ও মতির বিরুদ্ধেও নিহত প্যানেল মেয়র নজরুলের পরিবার অভিযোগের আঙ্গুল তুললেও পরবর্তীতে তারা প্রভাবশালী মহলের চাপে আর অভিযোগ করেনি।
এর আগেও মতির বিরুদ্ধে উঠেছিল নানা অভিযোগ সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতির পদে থাকা যুবলীগ নেতা মতির বিরুদ্ধে। আগেও নারায়ণগঞ্জে ৬ নং ওয়ার্ড (এসও রোড) এলাকার ৫ পরিবারের জমিতে নিজের ও তানজিল হোসেন নামে সাইনবোর্ড টানানো হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৪ জন ভয়ে মুখ না খুললেও স্বপন নামের এক ব্যক্তি মতির বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে। অভিযোগে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার নিকট হতে ৭৯৫০ বর্গফুট জমি লিজ এবং তার পাশেই আড়াই শতাংশ জমি মোস্তফা কামালের কাছ থেকে স্বপন ক্রয় করে। এরই মধ্যে মতি তার জমিতে সাইনবোর্ড সেটে দেয়। মতি আমজাদ ভুইয়া, কোহিনুর বেগমসহ বেশ কয়েকজনের জায়গায় নিজের নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে জমির মালিক বলে দাবি করছে।
এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে মতিউর রহমান মতির প্রাইভেটকারের চাপায় স্কুল ছাত্র সীমান্ত (১০) নিহত হয়। মতি এলাকাতে প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় এলাকাবাসী গাড়িটি আটক করে পুলিশে দেওয়ার সাহস করেনি।
এমন অসংখ্য ঘটনা ছাড়াও মতির বিরুদ্ধে এমন কোন অপরাধ নাই যা মতি ও তার বাহিনী দ্বারা সংঘঠিত হয় না । জ্বালানী তেল চুরির মহোৎসবের বিশাল একটি অংশ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য ও বিশেষ পেশার অনেকের কাছে নিয়মিত পৌছে দেয়ায় মতি ও তার বাহিনীর অপরাধীদের বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলতে পারে না । রাজনীতিবিদ, প্রশাসন ও বিশেষ পেশার উচ্ছিষ্ট ভোগিদের বিশাল তালিকা ছাড়াও মতি বাহিনীর অপরাধীরা স্বচ্ছ গণমাধ্যমকর্মীদের শাযেস্তা করতে নানা পন্থায় অপরাধী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে ।
সাত খুনের ফাঁসির আসামী কাউন্সিলর নূর হোসেন যেমন বিশাল সাম্রাজ্য চালাতে তৎসময় ডিসি, এসপি, র্যাব, থানার ওসি, বিভিন্ন গণমাধ্যমকে হুমকি দিয়ে একজন প্রভাবশালী নেতার নাম ব্যবহার করতো, নিজ পুত্রক হত্যার পর খোদ তৎকালীন সময়ের ডিসি, এসপি, র্যাবের সিইওসহ বিশেষ পেশার অনেকেই ঘটনা আড়াল করতে যারপরনাই কর্মকান্ড চালিয়ে পুরো জেলাবাসিকে অতিষ্ট করে তুলেছিলো । ঠিক তেমনি ডিসি এসপি র্যাবের সিইও দূর্ধর্ষ মতির পাশে না থাকলেও বর্তমানে এই মতি ও তার বাহিনী অনেক শীর্ষ নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে অপরাধ সাম্রাজ্য চালিয়েই যাচ্ছে । এক নূর হোসেন ফাঁসির কনডেম সেলে থাকলেও আরেক নূর হোসেনের মতোই অপরাধীদের হোতা কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি বীরদর্পে সিদ্ধিরগঞ্জের সকল অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে । যার ভয়ে অনেকেই নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে উর্লেখিতএমন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করেন।









Discussion about this post