আজ সোমবার সকালে আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার রমজানবেগ এলাকার মিনু বেগম। গতকাল রোববার দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীর মাহমুদনগর কলাবাগান এলাকায় রূপসী-৯ নামের কার্গোর ধাক্কায় এমএল আশরাফউদ্দিন নামের লঞ্চডুবির ঘটনায় মারা যাওয়া আরিফা বেগমের চাচিশাশুড়ি তিনি।
এর আগে গত বছরের ৪ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে এমএল সাবিত আল হাসান লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যান মিনু বেগমের পুত্রবধূ বীথি বেগম। ওই লঞ্চ মদনগঞ্জ এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছাকাছি এসএকে এল-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে গিয়েছিল। এতে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যাঁদের অধিকাংশের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ।
এ ছাড়া ২০২০ সালের ২৯ জুন এমএল মর্নিং বার্ড নামে যাত্রীবাহী একটি লঞ্চ মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। এতে মুন্সিগঞ্জের ৩৪ জন মারা গিয়েছিলেন।
গতকাল দুপুরে ডুবে যাওয়া এমএল আশরাফউদ্দিন লঞ্চটি অন্তত ৩০ যাত্রী নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জে যাচ্ছিল। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আটজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আরিফা ও তাঁর দেড় বছরের ছেলে সাফায়েত রয়েছে। তবে বেঁচে গেছেন আরিফার চাচাশ্বশুর আবদুর রব। তাঁকে ফতুল্লার একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকে আরিফা-সাফায়েতের বাড়িতে আহাজারি করছিলেন স্বজনেরা। তাঁদের বিলাপে প্রতিবেশীদের চোখও আর্দ্র হয়ে ওঠে। আজ সকালে বাড়ির উঠানে বিলাপ করছিলেন সাফায়েতের দাদি রোসি বেগম (৬০)। তিনি বলেন, ‘কত সুন্দর কইরা কথা কইত সাফায়েত! সারা দিন পাশে ঘুরঘুর করত। হাসত, খেলত। ওর কথা শুইনা পরানডা জুড়াই যাইত। কেমনে হারায় গেল আমার নাতি! কই পামু আমার নাতিরে? কই পামু আমার ছেলের বউরে?’
গতকাল রোববার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে রমজানবেগ এলাকার সামাজিক কবরস্থানে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয় আরিফা ও তাঁর ছেলে সাফায়েতকে। স্ত্রী ও ছেলেকে হারানোর শোকে বাক্রুদ্ধ দীন ইসলাম। সকালে বিমর্ষ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমার তো সব শেষ হইয়া গেল! আমি কারে লইয়া বাঁচমু! আরিফা-সাফায়েতরে না দেইখা কেমনে থাকমু। আল্লাহ, যে আমার সব শেষ করল, তুমি তার বিচার করো।’
চাচাশ্বশুর আবদুর রবকে নারায়ণগঞ্জে চিকিৎসক দেখিয়ে ওই লঞ্চে করে বাড়িতে ফিরছিলেন আরিফা বেগম। সঙ্গে ছিল ছেলে সাফায়েত। আজ সকালে আবদুর রব বলেন, ‘দেখলাম পেছন থেকে একটা জাহাজ আসল। লঞ্চে ধাক্কা দিল। লঞ্চটা বইট্টা গেল। বউ (আরিফা) কইল, “আব্বা কী হইছে?” আমি কইলাম, “লঞ্চ অ্যাকসিডেন্ট হইয়া গেছে গা।” বউয়ের হাত ধইরা লঞ্চ থেইকা বের হইতে লইছি। এমন একটা ঢেউ আইলো যে বাম হাত দিয়া লঞ্চ আর ডাইন হাত দিয়া বউরে টাইন্না আনছি। কিন্তু ঢেউ আইসা বউরে আমার হাত থেইকা ছুটাইয়া নিয়া গেছেগা। একটা প্লাস্টিকের বস্তা পাইছি। সেইটা ধইরা বস্তার ওপরে অজ্ঞান হইয়া গেছি। আমার আর কিছু মনে নাই। আল্লাহ আমারে বাঁচায় রাখল, ওগো দুইজনরে নিয়া গেল!’
তিনি বলেন, একের পর এক দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের মানুষ মারা যাচ্ছে। আর কত মানুষ মারা গেলে এ নৌপথ সুরক্ষিত হবে?
এদিকে এমএল আশরাফউদ্দিন লঞ্চডুবির ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে মুন্সিগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার জয়নাল ভূঁইয়ার। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর বাড়িতেও চলছিল শোকের মাতম। দুই মেয়ে ও এক ছেলে বাবার কথা বলে কাঁদছিল আর মূর্ছা যাচ্ছিল।
জয়নাল ভূঁইয়ার ছেলে নাজমুল হাসান (১৬) বলে, সে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। তার বাবার আয়ে সংসার চলত। বাবার মৃত্যুতে পরিবারের অবস্থা ভেঙে পড়বে।। যারা প্রতিনিয়ত এভাবে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানিয়েছে নাজমুল।
সূত্র : প্রথম আলো








Discussion about this post