বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী এবি সিদ্দিক অপহরনের ৮ বছর আজ। শুধু নারায়ণগঞ্জেই নয় গোটা দেশব্যাপী আলোচিত ছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী এবি সিদ্দিক অপহরণের এই ঘটনা।
চাঞ্চল্যকর ও শ্বরুদ্ধকর এমন অপহরণের প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর এবি সিদ্দিককে উদ্ধার করা হলেও বিগত ৮ বছরেও পুলিশ অপহরণের কারণ ও রহস্য আজো উদ্ধার করতে পারে নাই ।
তবে পুলিশ বলছে, নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের কারণে মামলার পূর্বতন তদন্ত কর্মকর্তা বদলী হয়ে যাওয়ায় এগোয়নি এ বি সিদ্দিক অপহরণের তদন্ত কার্যক্রম। অপরদিকে পুরো নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞ মহলের অনেকের ধারণা একটি প্রভাবশালী ভূমিদস্যু চক্র বেলা নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে শায়েস্তা করতেই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে । পরবর্তীতে ওই চক্রই সাত খুনের মতো ঘটনানোর দুঃসাহস করে । তবে এই চাঞ্চল্যকর অপহরণের নেপথ্যে কারা এবং গডফাদার চক্রের মুখোশ উম্মোচনের জোড়ালো দাবী দেশবাসীর মাঝে নাড়া দিলেও খোদ এমন ঘটনার ভিকটিম ও বাদী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তার স্বামীকে ফিরে পাওয়ার পর আর তেমন সোচ্চার হতে দেখা যায় নাই। একই সাথে পরিবেশ আন্দোলনে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে আর তেমন প্রতিবাদী হতে দেখা যায় নাই । প্রতিনিয়তঃ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের টক শো তে পরিবেশ রক্ষায় কঠোর হলেও পরবর্তীতে আর টিভির পর্দায় দেখা যায় নাই এই পরিবেশবিদকে। ফলে অনেকেই মনে করেন সারাদেশে চাঞ্চল্যকর এবি সিদ্দিক অপহরণ মামলা দ্রুত ও কঠোর হস্তে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হলে সাত খুনের ঘটনা আর ঘটাতে সাহস করতো না অপরাধীরা। সাত খুনের প্রধান হোতা নূর হোসেন যেমন চিহ্নিত হয়েছে তেমনি চিহ্নিত হতো এবি সিদ্দিক অপহরণের নেপথ্যের মূল গডফাদারদের ।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভূইগড় এলাকা থেকে অপহৃত হয়েছিলেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী এবি সিদ্দিক। ফতুল্লার দাপাস্থ গার্মেন্ট থেকে নিজস্ব লাল রঙয়ের প্রাইভেটকারে (ঢাকা মেট্রো গ ১৫-৮৮০০) চড়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক ও চালক রিপন। তাদের গাড়িটি ভূইগড় দেলপাড়া ভূইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে আসার পর পেছন থেকে নীল রঙয়ের একটি হাইএস গাড়ি মৃদু ধাক্কা দেয়। পরে তাকে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। ওই অপহরণের ঘটনা গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরদিন নারায়ণগঞ্জে সড়ক অবরোধসহ সারাদেশে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। ৩৬ ঘন্টা পরে তাকে মিরপুর কাজীপাড়া এলাকায় ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। পরে একটি সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে আসার পথে রাজধানীর কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে স্থাপিত চেকপোস্টে তাকে খুঁজে পায় পুলিশ। পরে পরিচয় পেয়ে তাকে ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। উদ্ধারের পর রাতেই ঢাকার ধানমন্ডির বাসায় নেয়া হয় সিদ্দিককে।
শ্বাসরুদ্ধকর ৩৬ ঘন্টা অপহরণের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে এবি সিদ্দিক ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ৫-৬ জন অপহরণকারী তাকে জোর করে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। পরে হাত, পা, চোখ বেঁধে একটি মাস্ক বা কাপড় পড়িয়ে শুইয়ে দেয়। অপহরণকারীরা সকলেই স্বাস্থ্যবান ছিল এবং তাদের সকলেরই বয়স ছিল ৩৫ এর মতো। এর মধ্যে একজন ছিল ভিন্ন ধরনের ভাল জামাকাপড় পড়া। ওই যুবকটি আমাকে পিস্তল ধরেছিল। আমাকে গাড়ি ওঠানোর পরে গাড়িটি কিছুক্ষণ চলার পরে একটি ফেরী পার হয়। আমাকে অন্য একটি গাড়িতে উঠিয়ে আবার চলতে শুরু করে। এরপর আরো একটি ফেরী পার হয়। সর্বমোট ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা গাড়ি চলার পর সন্ধ্যার দিকে একটি বাড়ির মেঝেতে আমাকে নিয়ে রাখা হয়। অপহরণকারীরা আমাকে কোন ধরনের টর্চার করেনি কিংবা খারাপ আচরণ করেনি। ওইদিন রাতে তাদের ভাই বা গুরু পরিচয়ে একজন এসে আমার পরিচয় জানতে চান। ওই ব্যাক্তিটি (গুরু) আমাকে বলেন তুই তো মনে হয় অনেক টাকার মালিক। তখন আমি তাকে বলি টাকা লাগলে আমার বাড়ির নম্বর নেন। কিন্তু আর কিছু না বলে ওই ব্যাক্তিটি চলে যায়। পরদিন রাতে ওই ব্যাক্তিটি আবার এসে বলে, তুই তো অনেক বিখ্যাত লোক। তোকে মেরে ফেললেও লস। কারণ মেরে ফেললে টাকা পাবেনা। তার চেয়ে বরং তোকে ছেড়ে দেই। পরে ১৭ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে ওই বাড়ি থেকে বের করে এক থেকে দেড় ঘণ্টা গাড়িতে করে চলার পর আনসার ক্যাম্পের সামনে ৩০০ টাকা হাতে দিয়ে চোখ বাধা অবস্থায় নামিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সিদ্দিক বলেন, ‘চোখ বাঁধা থাকায় কাউকে চিনতে পারেননি। তবে তাদের ফিসফিস কথা শুনেছি।’ দুর্বৃত্তরা যখন আমাকে মিরপুরে নামিয়ে দেয় তখন আমার শার্ট ছেড়া ও পা খালি ছিল। পরে আমি রিকশা নিয়ে কাজীপাড়া হয়ে এরপর একটি সিএনজি নিয়ে ধানমন্ডি যাওয়ার সময়ে পুলিশের একটি চেকপোষ্টে আমার গাড়িটি থামানো হয়। আমি নিজের পরিচয় দেওয়ার পরে প্রথমে তারা বিশ্বাস করতে পারেনি। এরপর একজন কনস্টেবল আমাকে চিনতে পারে। পরে পুলিশের ভ্যানে করে প্রথমে আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আদালত এবি সিদ্দিকের জবানবন্দি ১৮ পৃষ্ঠায় রেকর্ড করেছেন। ওই জবানবন্দি পর্যালোচনা করে অপরাধীদের সনাক্ত করা যায়নি। এবি সিদ্দিক অপহরণের ১১ দিন পরেই নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনা ঘটে। এরপর মামলাটির ওই সময়কার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলী হয়ে যায়। পুলিশ প্রশাসনেও ব্যাপক রদবদল হয়। যার কারণে মামলাটির তদন্ত কাজ বেশীদূর এগোয়নি।









Discussion about this post