নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে থাকা নগরীর শহীদ জিয়া হল মিলনায়তনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় ৫ বছর আগে। কিন্তু সেই পরিত্যক্ত হলের নিচ তলা আর বাইরের প্রাঙ্গণে চলছে বিশাল বিদেশি পণ্যের মেলা।
অথচ এই মেলার ব্যাপারে কিছুই জানেন না জেলার সব ব্যবসায়ী সংগঠনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অবাক কমার্সের কর্মকর্তারাও। এমনকি বাংলাদেশ উইভার্স প্রডাক্ট অ্যান্ড ম্যানু. বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন নামে (তাঁতি সমিতি) কোনো সংগঠন আছে বলেও তারা জানেন না। উল্টো এই মেলা নিয়ে চরম ক্ষোভ চলছে ব্যবসায়ীদের মাঝে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাংলাদেশ উইভার্স প্রডাক্ট অ্যান্ড ম্যানু. বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন নামের ওই সংগঠনের সভাপতি পরিচয় দানকারী জনৈক সালাউদ্দিন এই মেলার নেপথ্যের প্রধান কারিগর। রমযানের এক মাসের জন্য মেলার অনুমতি নেয়া হলেও এই মেলা চলবে আগামী কোরবানির ঈদ পর্যন্ত। জেলা প্রশাসনসহ নানা মহল ম্যানেজ করেই এই মেলা করছেন তিনি। করোনা কালের আগেও তিনি একাধিকবার এই পন্থায় এই মেলা করেছিলেন বটে কিন্তু স্থানীয় গণমাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরলে মাঝ পথেই মেলা বন্ধ করতে হয়েছিল।
সরেজমিনে গিয়ে জিয়া হলে প্রবেশের মুখেই চোখে পড়ে মেলার বাইরে জিয়া হলের ২ প্রধান ফটকের বাইরে ফুটপাতও দখল করে দেয়া হয়েছে ৩ ফুট বাই ৩ ফুটের ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান।
জানা গেল, এসব দোকান থেকে নেয়া হয়েছে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা সালামী। আর মেলার অভ্যন্তরে সর্বনিম্ন ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সালামি নিয়ে দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছে ১ মাসের জন্য।
পরিত্যক্ত জিয়া হলের নিচ তলার সম্মুখ ভাগের পুরাটেই শোভা পাচ্ছে বিশাল এক বিদেশী কাপড়ের দোকান। মেলার ২০টি স্টলের মধ্যে মিয়াকো ইলেক্ট্রনিক, আলিফ সুজ, ডিজাইন ইলেক্ট্রনিক্স, ঢাকা ফ্যাশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দোকান রয়েছে।
মেলার এসব দোকানে যে পরিমাণ আলোকসজ্জা করা হয়েছে সেই বিদ্যুৎ সংযোগের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল আরেক দৃশ্য। ডিপিডিসি থেকে দেড় লাখ টাকার পে-অর্ডারে একটি অস্থায়ী মিটার নেয়া হলেও সরাসরি বিদ্যুতের খুঁটি থেকেও অবৈধ সংযোগ নিয়ে চলছে এখানকার আলোকসজ্জা।
এর মধ্যে মেলার প্রবেশ পথে নামে মাত্র একটি জামদানি শাড়ির দোকান রয়েছে। এ মেলাটি যাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে সেই গরীব অসহায় ও দুঃস্থ তাঁতিদের কারো জন্য এক হাত জায়গাও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তার কারণ হলো- জামদানি তাঁতিরা মেলার আয়োজক সালাউদ্দিনের চাহিদা মতো দোকান ভাড়ার টাকা দিতে পারেন না।
হিসেব মতে, জেলা প্রশাসন থেকে দুস্থ তাঁতিদের কল্যাণের কথা বলে নেওয়া এই বিনা পয়সার মেলায় সংগঠনের নেতা সালাউদ্দিনের পকেটে ঢুকেছে প্রায় দেড় কোটি টাকা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সালাউদ্দিনের এই মেলা করার পেছনে রয়েছে বিশাল একটি চক্র। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার পকেট ভারি করেই এই মেলা করছে সালাউদ্দিন।
উইভার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, এক সময় সালাউদ্দিন রাস্তায় হেঁটে কাপড় বিক্রি করতেন। বর্তমানে তিনি কোটিপতি। ৪-৫টা বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে জমি ক্রয় করেছেন তিনি। এছাড়াও একটি টেক্সটাইল মিলও ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন। এসবই গরিব অসহায় ও দুঃস্থ তাঁতিদের কল্যাণের নামে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় গড়েছেন।
জামদানি তাঁতি আউয়ুবুর রহমান বলেন, গরিব তাঁতিদের কল্যাণের নামে সালাউদ্দিন নিজের পকেট ভারি করছেন। তিনি শুধু তাঁতিদের ক্ষতি করছেন না, তিনি জামদানিরও ক্ষতি করছেন।
জেলার রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারের বেশ কয়েকজন প্রবীণ তাঁতির সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, জামদানি তৈরিতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও রূপগঞ্জে অন্তত ৩ শতাধিক তাঁতি রয়েছেন। আর এ তাঁতিদের সরলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ উইভার্স প্রডাক্ট অ্যান্ড ম্যানু. বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন গরিব অসহায় ও দুঃস্থ তাঁতিদের কল্যাণার্থে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক যুগ সময় ধরে মেলা করে আসছে। এসব মেলায় বিদেশি পণ্য ছাড়া কোনো গরীব অসহায় ও দুঃস্থ তাঁতিদের জামদানি শাড়ির দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয় না।
শুধু তাই নয় আর্থিকভাবেও কোনো সহযোগিতা করা হয় না তাঁতিদের। এছাড়া সংগঠনের অধিকাংশ নেতাদের দাবি আয় ব্যয়ের হিসাব তো দূরের কথা মেলার লভ্যাংশ কোনো সময় সংগঠনের ফান্ডে রাখা হয়নি বলেও তারা অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল জানান, এই মেলা যে সংগঠন এর নামে করা হচ্ছে তাদের আমরা চিনি না। আর এই মেলা কিভাবে হচ্ছে কে করছে তার কিছুই ব্যবসায়ীরা জানেন না।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সারা বছর ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স ভ্যাট দিয়ে কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে ব্যবসা করছেন ঈদ, পূজার কেনাকাটায় লাভের আশায়। আর এখানে ১ মাসের জন্য মেলা নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাইরের ব্যবসায়ীরা এসে মেলা করে এখানকার ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করে যাচ্ছেন।
এদিকে মেলার আয়োজকদের মধ্যে বাবু নামের একজনকে ফোনে দোকান নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি জানান, দোকান প্রতি দেড় লাখ টাকা দিতে হবে চাঁদ রাত পর্যন্ত এবং কোরবানি ঈদ পর্যন্ত নিতে চাইলে নতুন করে চুক্তি করতে হবে।
এদিকে যার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ সেই উইভার্সের সভাপতি সালাউদ্দিনকে ফোনে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি না হয়ে একাধিকবার দেখা করার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। তার সাথে সরাসরি কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, শুধু জামদানি শাড়ির দোকান দিলে মেলায় লাভ বলতে কিছুই থাকে না। এখন শাড়ি কেউ কেনে না। তাই নানা ধরনের আইটেমের দোকান রাখতে হয়।
তিনি জানান, করোনার আগে চাষাঢ়া জিয়া হলে মেলা করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ওই সময় জেলা প্রশাসক নানাজনের অভিযোগে মেলা উচ্ছেদ করে দিয়েছে। এ বছর সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর উইভার্স সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওই সময় থেকে এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছি। বর্তমানে আমাদের সংগঠনে প্রায় ২৫০ জন সদস্য রয়েছেন। সদস্যদের তেমন কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় সংগঠনের ফান্ডে ১০ টাকাও জমা রাখতে পারিনি।
সালাউদ্দিন দাবি করেন, সব মিলিয়ে মাত্র ১৫ লাখ টাকা দোকান ভাড়া পেয়েছেন এবং ১৩ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু আয়োজকদের রেকর্ডিং শোনানোর পর তিনি প্রতিবেদককে বিষয়টি চেপে যেতে নগদ অর্থ দেয়ারও চেষ্টা করেন।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নেজারত শাখার নাজির কামরুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে জানান, তাঁতিদের কল্যাণে জিয়া হলের খালি মাঠে বিনা মূল্যে মেলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ মেলায় কোনো বিদেশি পণ্য বিক্রি করতে পারবে না। এখানে শুধু তাঁতিরাই তাদের তাঁতবস্ত্র প্রদর্শন ও বিক্রি করবেন। আয়োজক যদি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এখানকার বিদ্যুৎ সংযোগ কি ভাবে দেয়া হলো এবং গত ১৫ দিনেও কেন জেলা প্রশাসনের নজরদারি ছিল না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্বাস করে দেয়া হয়েছিল কিন্তু এখন জানতে পেরে আমরা সংগঠনের সভাপতি সালাউদ্দিনকে ডেকেছি। কোন ব্যত্যয় পাওয়া গেলে মেলা বন্ধ করে দেয়া হবে।
তবে সোমবার পর্যন্ত এই মেলা নিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
সূত্র : যুগান্তর








Discussion about this post