সারাদেশের চাঞ্চল্যকর নারায়ণগঞ্জের সেই ৭ খুনের ৮ বছর আজ । নৃশংসতা শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীকেই নয় পুরো বিশ্ববাসীকেও নাড়া দিলেও এখনো দণ্ডপ্রাপ্তরা ফাঁসিতে ঝুলেনি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত ছিল ৭ খুনের ইস্যুটি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্স র্যাব সদস্যদের সম্পৃক্ততায় নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে তো বটেই দেশের ইতিহাসেও ন্যক্কারজনক ঘটনার একটিতে পরিণত হয়েছিলো ৭ খুনের ঘটনাটির আজ আট বছর ।
আজকের এই দিনে আট বছর পূর্বে দুপুরের পূর্বেই (সাড়ে ১২ টা) নারায়ণগঞ্জ আদালত চত্তরেই তৎকালীন পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম ও ফতুল্রা থানার ওসি আক্তার হোসেনের উপস্থিতিতেই কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণের চেষ্টা করে র্যাবের খুনি চক্রের সদস্যরা। অপহরণের শিকার হয়ে সাহস নিয়ে কাউন্সিলর নজরুল র্যাবের অপহরণকারী দুই সদস্যকে আটকে করে কোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করলেও শেষ রক্ষা হয় নাই কাউন্সিলর নজরুল – অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ সাত জনের । আদালত চত্তরের এই অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে র্যাবের অপহরণকারী চক্রের হাতে প্রাণ দিতে হতো না এই সাত জনকে।
তবে আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের ৮ বছর পূর্ণ হলেও অদ্যাবধি হত্যাকাণ্ডের রায় বাস্তবায়ন হয়নি। নিম্ন আদালতের পরে হাইকোর্টেও দ্রুত রায় ঘোষণা করা হলেও আপিল বিভাগে রায়টি নিষ্পত্তি হতে ধীরগতির অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা।
৭ জনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
৭ জনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। যাতে করে মরদেহ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা মরদেহগুলো হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেওয়া হয় প্রতিটি মরদেহগুলোর সঙ্গে। মরদেহগুলো মুখ ছিলো ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো।
মামলা চলাকালে প্রধান আসামিকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামিদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেলো পৌনে তিন বছর ধরেই আলোচিত ছিল ৭ খুনের মামলাটি। তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন,র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ।
ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। দু’টি মামলায় নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৩ জন কারাগারে আটক রয়েছেন। আর চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে এখনো ১২ জন পলাতক রয়েছে।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দু’টি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দু’টি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী ১২৭ জন। এর মধ্যে দু’টি মামলার বাদী, দু’জন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো ও তাদের বক্তব্য গ্রহণের কার্যক্রম। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। গত ৩০ নভেম্বর শেষ হয় আলোচিত ৭ খুন মামলার আইনি কার্যক্রম। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন।
নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ অধিনায়ক মেজর (অব) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কমান্ডার (অব) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও মরদেহ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামিকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং মরদেহ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সাত খুনের মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, সরকার শুরু থেকে মামলাটি নিয়ে নানা টালবাহান করেন। এটি সরকারের স্বদিচ্ছায় দ্রুত নিস্পত্তি করে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তসহ সবার রায় দ্রুত বাস্তবায়ক করা উচিত। এ রায় বাস্তবায়ন না হলে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরো উৎসাহিত হবে। বিচারহীনতায় যেন আমাদের অপরাধীরা উস্কে না যায় তাই দ্রুত এ রায় বাস্তবায়নের দাবি করছি।
ফাঁসির ১৫ জন আসামি
হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড আসামিরা-প্রধান আসামি নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (পলাতক), সৈনিক আলামিন শরিফ (পলাতক) ও সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক)।
যাবজ্জীবন ১১ জনের
১১ জনকে ১৬ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলেও ২২ আগস্ট হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। তারা- র্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, জামালউদ্দিন, এনামুল কবীর, সানাউল্লাহ সানা (পলাতক), শাহজাহান (পলাতক)।
কারাদণ্ড ৯ জনের
এর আগে ১৬ জানুয়ারি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে যাদের রায় ২২ আগস্ট হাইকোর্ট বহাল রেখেছে। অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। হাইকোর্ট তাদের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে।
সেই ৭ খুন : যেভাবে অপহরণ ও হত্যা
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নাসিক কাউন্সিলর নূর হোসেনের সাথে চুক্তি মোতাবেক প্রথমে নূর হোসেনের চরম প্রতিদ্বন্ধী কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে অপহরণের চেষ্টা করে আদালত চত্তরেই। এ দিন আদালতের মামলায় নিস্পত্তি হওয়া প্রায় কোটি টাকার মাদক ধ্বংস করতে আদালত চত্তরের অবস্থান নেয় পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম ও ফতুল্লা থানার ওসি আক্তার হোসেনসহ পুলিশের অনেক কর্মকর্তা এবং চীফ জুডিশিয়াল ম্যাুজিস্ট্রেট আদালতের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট । দুপুর প্রায় সাড়ে ১২ টার সময় আদালত চত্তরে দৌড়ঝাপ । দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই আতংকিত অনেকেই বলেছেন, “জঙ্গিরা হামলা করেছে, একজন কাউন্সিলর কে অস্ত্র ঠেকিয়ে তুলে নিয় যাচ্ছে । অস্ত্রধারী দুইজনকে আটক করে জেলা জজ আদালতের দায়িত্বরত পুলিশের হাতে হস্তান্তর করেছে ।“
এমন খবরে পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম ও ফতুল্লা থানার ওসি আক্তার হোসেন দুই জনই দৌড়ে আদালতের জিআরও শাখার সামনে থেকে জজ কোর্টের গেইটের সামনে এসে অজ্ঞাত নাম্বারে ফোনে কথা বলে আবার ফিরে যান সেই ১০ গজ পিছনের জিআরও মাখার সামনে । যেখানে ধ্বংস করার জন্য রাখা হয়েছে বিশাল মাদকের স্তুপ।
শুধু কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে আদালত চত্তর থেকে অপহরণ করতে ব্যর্থ হয়েই শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত অপহরণ করে র্যাবের অপহরণকারী দল।
৩০ এপ্রিল বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল। পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি মরদেহে ইটভর্তি দু’টি করে বস্তা বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।









Discussion about this post