মায়ের সামনে থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে রাতভর নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার শুভ্রত মন্ডল (১৮) মারা গেছে। ৬দিন মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরিয়ে রোববার ভোর সাড়ে ৬ টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।
নিহত শুভ্রত শহরের জিউসপুকুর পাড় শনিমন্দির সংলগ্ন এলাকার মাঈনুদ্দিন মিয়ার বাড়ীর ভাড়াটিয়া সুরেশ মন্ডলের ছেলে। সে পেশায় হোসিয়ারী শ্রমিক ছিল।
এ ঘটনায় নিহতের মা গৌরি মন্ডল বাদী হয়ে রোববার বিকালে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় তার ছেলে মৃত্যুর আগে যাদের নাম বলে গেছে তাদের আসামী করা ছাড়াও অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামী করেছেন।
পারিবারিক প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য মতে জানা যায়, শহরের একটি হোসিয়ারীতে কাজ করতো শুভ্রত মন্ডল। ঘটনার দিন ১৫ মে সারাদিন কাজ শেষে রাতে বাড়ীতে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হচ্ছিল শুভ্রত। আর সন্তানের জন্য মা খাবার রেডি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ শুভ্রতের মোবাইলে একটি কল আসে তার পরিচিত নাম্বার থেকেই। সায়েম ওরফে ইয়াবা সায়েম নামে পরিচিত ওই যুবকটি শুভ্রতকে বলে, ‘শুভ্রত কই আছোস?’ শুভ্রত বলে আমি এই মাত্র বাসায় এলাম। সায়েম বলে একটু গেটের বাইরে আয়তো। শুভ্রত বলে নারে, এখন আসতে পারবো না, মা-য় ভাত দিচ্ছে, এখন খেতে বসবো। সায়েম বলে আরে বেশি সময় নেবো না, একটু কথা বলেই ছেড়ে দিবো। তারপরও শুভ্রত সায়েমকে না করে দেয়। পরে রাত সোয়া ১২টার দিকে সায়েম আবারও শুভ্রতকে মোবাইলে কল দিয়ে বাইরে আসতে বলে। এরপর মাকে নিয়ে শুভ্রত বাসা থেকে বের হয়। বাড়ীর গেটের বাইরে বের হওয়ার পর পরই পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্র ঠেকিয়ে মায়ের সামনে থেকে শুভ্রতকে মোটর বাইকে উঠিয়ে অপহরণ করে নিয়ে যায় সায়েম গংরা। এরপর শুভ্রত মন্ডলে মা-বোনসহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশিরা বিভিন্নস্থানে শুভ্রতকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও তার সন্ধ্যান পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, শুভ্রত মন্ডলকে তুলে নিয়ে শহরের পশ্চিম দেওভোগ ইউসূফ মিয়ার বাড়ীর সামনের রাস্তায় ফেলে ইয়াবা সায়েম, সাজিত, নাঈমুদ্দিন সাজু, দোলন, রাকেশ, ড্যান্ডি আল আমিন, শুভ, ভোটকা শুভ, নিরভ, প্রণয়, নোমান সিকদার, অন্ত সাহা ও নাপতা প্রিতমসহ প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন কিশোরগ্যাংয়ের সন্ত্রাসীরা তার উপর পশুদের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথারীভাবে মারধর শুরু করে। মারধরের একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা দেখলে গা শিউরে উঠবে যে কারো। তাতে দেখা যায়, কেউ কেউ চিৎকার করে বলে ওরে মেরে ফেল। শুধু তাই নয়, শুভ্রতকে হত্যার উদ্দেশ্যে দেশিয় অস্ত্র দিয়ে তার শরীরের একাধিকস্থানে কুপিয়ে জখম করা হয়। এসময় শুভ্রত মন্ডল তাদের পায়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চেয়ে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু এতে সন্ত্রাসীদের মন গলাতে পারেনি সে। যতবার শুভ্রত প্রাণভিক্ষা চেয়েছে, ততবারই সন্ত্রাসীরা তাদের টর্চার আরও বাড়িয়ে দেয়। কখনো শুভ্রতের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলে, পায়ে কোপ দেয়, শরীরে লাঠিপেটা করে নানাভাবে টর্চার করতে থাকে। এ যেন মধ্যযুগীয় নির্মমতাকেও হার মানায়। একসময় অচেতন হয়ে পড়ে শুভ্রত। তখন সন্ত্রাসী মৃত ভেবে তাকে তার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে বীরদর্পে চলে যায়।
এদিকে মৃত প্রায় শুভ্রতকে তার বাড়ীর সামনে পড়ে থাকতে দেখে এলাকাবাসী তার আত্মীয় স্বজনকে খবর দেয়। পরে সেখান থেকে শুভ্রতকে দ্রুত উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা (ভিক্টোরিয়া) জেনারেল হাসাপাতালে নেওয়া হলেও শুভ্রতের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে। সেখানে রোববার রাত ১২টার দিকে সে মারা যায়।
মৃত্যুর আগে খুনিদের নাম বলে গেছে শুভ্রত
মৃত্যুর আগে সে ভিডিওতে একটি জবাববন্দি দিয়ে গেছে। সেখানে কারা এবং কেন তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে সে তাদের নাম বলে গেছে। ওই ভিডিও ফুটেজ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে সে বলেছে নাসিক নির্বাচনে ১৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মনির হোসেনের পক্ষে তাকে কাজ করতে বলেছিল সায়েম গংরা। কিন্তু সে বলেছে করোনার সময় শফিউদ্দিন আমাদের সাহায্য করেছে। আমি তার নির্বাচন করবো। এটা তারা মনের ভেতর রেখে দেয়। নির্বাচনে শফিউদ্দিন পরাজিত হয়। মনির হোসেন বিজয়ী হয়। প্রতিশোধ নিতে ইয়াবা সায়েম, সাজিত, নাঈমুদ্দিন সাজু, দোলন, রাকেশ, ড্যান্ডি আল আমিন, শুভ, ভোটকা শুভ, নিরভ, প্রণয়, নোমান সিকদার, অন্ত সাহা ও নাপতা প্রিতমসহ ১৫-২০ জন আমাকে নির্যাতন করেছে।
নিহতের মা গৌরী মন্ডল, বোন লিপি মন্ডল ও শম্পা মন্ডল আহাজারি করে বলেন, কাউন্সিলর মনিরের লোকজন শুভ্রতকে হত্যা করিয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।
তবে নাসিক কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনির জানান, তার কোন বাহিনী নাই। যারা এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই।
অপরদিকে সাবেক কাউন্সিলর শফি উদ্দিন প্রধান জানান, শুভ্রত মন্ডল আমার নির্বাচনে কাজ করেছে কি না তা আমি জানি না। তবে করোনার সময় আমি তাকে সাহায্য করেছি। আমি এই হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করছি।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ আনিচুর রহমান জানান, এই ঘটনায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে ।









Discussion about this post