নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে র্যাব অভিযান চালিয়ে দেশের ইতিহাসে সর্ব বৃহত্তম মদের চালান দুই কন্টেইনারে ৩৭ হাজার বোতল মদ উদ্ধার করতে গিয়ে উদঘাটন করেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জব্দ হওয়া মদের চালানটি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর ইউপির চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির ধর্ম বিষয়ক সহ-সম্পাদক আজিজুল ইসলামের।
এই চক্রের অন্যতম হোতা তিনি। তার বড় ছেলে মিজানুর রহমান আশিক (২৪) ও আব্দুল আহাদকে (২২) নিয়ে গড়ে তোলেন মাদকের সিন্ডিকেট। দুবাই থেকে এসব চালান পাঠায় একই এলাকার নাসির নামে এক ব্যক্তি।
মদের বড় চালান জব্দ করার অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলামের মেঝ ছেলে আব্দুল আহাদকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। রোববার রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার বাড়ি থেকে প্রায় ২ কোটি টাকার দেশি-বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়।
এ ঘটনায় রোববার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় র্যাব বাদী হয়ে মামলা করে। মামলায় ইউপি চেয়ারম্যানের ছেলে আব্দুল আহাদসহ তিনজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
অভিযানের সংবাদ পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম ও তার আরেক ছেলে মিজানুর রহমান আশিক শনিবার সকালে দেশত্যাগ করেছেন। তাদেরও ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে। জব্দ করা মদের আনুমানিক মূল্য ৩৭ কোটি টাকা।
রোববার বিকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন র্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মোহাম্মদ পাশা।
খন্দকার আল মঈন বলেন, গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের টিপর্দি পার্কিং স্ট্যান্ডের সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে দুটি কন্টেইনার তল্লাশি করা হয়। এ সময় চালকদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা র্যাবকে জানান, কন্টেইনারে সিগারেট রয়েছে। র্যাবের সন্দেহ হলে ওই দুই চালককে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা স্বীকার করেন কন্টেইনারে মদের চালান রয়েছে। চালানে কুমিল্লা ইপিজেড ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের নামে ভুয়া চালান তৈরি করে পোশাক কারখানার পণ্যের আড়ালে এই মদের বিশাল চালান আমদানি করা হয়। তবে ওই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
পরবর্তী সময়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলামের নাম। তিনি শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। এর আগেরবারও তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, শনিবার লরি চালক মো. নাজমুল মোল্লা ও মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম ও তার দুই ছেলের নাম প্রকাশ করেন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর ওয়ারীর দুটি বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। তবে র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে আগেই ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান সিন্ডিকেটের সবাই।
খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার আব্দুল আহাদকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, তার বাবা আজিজুল ইসলাম ও ভাইসহ তারা সবাই মদ আমদানি করতেন। শুধু চলতি বছরেই চারটি মদের চালান এনেছেন। প্রতিটি চালানে অন্তত ১৪ হাজার বোতল বিদেশি মদ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দুবাই থেকে তারা দেশে আনতেন। এর সঙ্গে কতিপয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টও জড়িত। ওই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে পোর্ট থেকে ভুয়া কাগজপত্র প্রদর্শন করে গার্মেন্টস পণ্যের নামে তারা মদের চালান খালাস করতেন।
এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে কাস্টমস বা সিঅ্যান্ডএফের কারও সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা গত শনিবার চালানটি আটকের পর প্রথমে নারায়ণগঞ্জ কাস্টমস কর্মকর্তাদের অবগত করার পর তারা সিলগালা করা কন্টেইনারটি খোলার পর তারাও এই চালান দেখে অবাক হয়েছেন। পরে তাদের উপস্থিতিতেই গণনা শুরু করা হয়। তারা কীভাবে এত বড় চালান প্রবেশ করা হলো সেটি তাদের ঊর্ধ্বতনদের জানিয়েছেন। শুল্ক কর্মকর্তারাও তদন্ত শুরু করেছেন।
তিনি আরও বলেন, দুটি কন্টেইনার টেইলার হতে তল্লাশি চালিয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩৬ হাজার ৮১৬ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা মাদকের সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ করা হয় ভ্যাটসহ ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তবে বেসরকারি হিসেবে এই চালানটির মূল্য অর্ধশতাধিক কোটি টাকা।
গতকাল সকালে অবৈধ চালান আমদানির সঙ্গে জড়িত আব্দুল আহাদকে গ্রেফতারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার ওয়ারীর ১২ তলার বাসায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ দেশি এবং বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়। জব্দ করা মুদ্রার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি টাকা ৯৮ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা, নেপালি রুপি ১৫ হাজার ৯৩৫, ইন্ডিয়ান রুপি ২০ হাজার ১৪৫, চায়না ইউয়ান ১১ হাজার ৪৪৩, ইউরো ৪ হাজার ২৫৫, থাই বার্থ ৭ হাজার ৪৪০, সিঙ্গাপুর ডলার ৯ এবং মালয়েশিয়ান রিংগিত ১৫।
অভিযানে গ্রেফতার মো. নাজমুল মোল্লার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে। তার বাবার নাম আকাশ মোল্লা। মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুলের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে। তার পিতার নাম জয়নাল আবেদীন শেখ। চক্রের অন্যতম হোতা আব্দুল আহাদকে রোববার সোনারগাঁ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে আহাদ জানান, এই মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা তিনি ও তার ভাই মিজানুর রহমান আশিক। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা তাদের বাবা মো. আজিজুল ইসলাম। তারা এক বছর ধরে এই অবৈধ কারবারের সঙ্গে জড়িত। তারা সিঅ্যান্ডএফের যোগসাজশের মাধ্যমে এই অবৈধ মাদক আমদানি কার্যক্রম করে থাকে। এই অবৈধ মাদক আমদানির ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কোম্পানির কাগজপত্র ব্যবহার করে থাকে। এই চক্রটি দেশে টিভি ও গাড়ির পার্টস ব্যবসার আড়ালে অবৈধ মাদকদ্রব্য বিপণনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। অবৈধ মাদক বিদেশ থেকে আনার পরে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, রাজধানীর বংশাল ও ওয়ারীতে ওয়্যার হাউসে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে সুবিধাজনক সময়ে অবৈধ মাদক বিপণন করে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে পরিবহন করা ট্রাক ও কন্টেইনার থেকে সরাসরি ক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করে থাকে।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, দুবাইয়ে থাকা মাস্টার মাইন্ড নাসির সেখানে একটি বিলাসবহুল হোটেলে কর্মরত। ওই হোটেলের নাম সুইস ইন্টারন্যাশনাল। তার কাছে ইউপি চেয়ারম্যান দুবাইয়ে যান অন্তত ১০ বার। তার ছেলে আশিকও ১০ বার গিয়েছে। আর গ্রেফতার আহাদ দুবাই যান ৬ বার। তারা দুবাই থেকে মদের চালান এনে দেশে বড় সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন।
বেপজার প্রতিবাদ : কুমিল্লা ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের কারখানার পোশাক ঘোষণায় আনা মদ আটক শীর্ষক প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। রোববার বেপজার নির্বাহী পরিচালক (জনসংযোগ) নাজমা বিন্তে আলমগীর স্বাক্ষরিত এই প্রতিবাদ পাঠানো হয়।
লিখিত প্রতিবাদে তিনি জানান, ভুয়া-জাল আমদানি অনুমতিপত্র ব্যবহার করে মদ আমদানির বিষয়ে বেপজার কুমিল্লা ইপিজেডের হাসি টাইগার কোম্পানি লিমিটেড ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের বিএইচকে টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানির ক্ষেত্রে জালিয়াত চক্র কুমিল্লা ও ঈশ্বরদী ইপিজেডস্থ দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছে।
একটি জালিয়াত চক্রকে অবৈধভাবে মদ আমদানির লক্ষ্যে ইপিজেডের দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছে যা ইপিজেড তথা বেপজার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এই ধরনের সংবাদ প্রচার দেশের বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।









Discussion about this post