‘অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া ১২ বছরের শিশু মো. হাসনাইনের পিতা রিকশাচালক ফজলুর রহমান বলেন, ‘চার্জশিটে মালিকপক্ষকে বাদ দেয়ার কথা আমরা শুনিনি। এইটা আমরা মানি না। আমাগো কথা একটাই, মালিকপক্ষের আমরা সাজা চাই ।‘
এভাবেই নিহতেদের প্রায় অনেকের পরিবার ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, ‘হাশেম ফুড কারখানায় ২০২১ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় যে কোন বিচার হবে না তা তা এই কারখানার মালিকদের গ্রেফতারের সাথে সাথেই আদালত জামিন দিয়ে দিয়েছে তাতেই প্রমাণ হয়েছে এরা কত ক্ষমতাধর । তাদের কোন বিচার করা যাবে না। তাদের বিচার করবে কে ? হাসেম ফুড কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তার চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহিম, তাওসীব ইব্রাহিম ও তানজিম ইব্রাহিম কোন অন্যায় করে নাই। অন্যায় করেছেন তারাই, যারা এই কারখানায় এসে আগুণে পুড়ে মরেছেন । তাদের মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত ! ৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় ৫ দিনও জেলে থাকতে হয় নাই ওদের।”
সোমবার (১৭ অক্টোবর) এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রূগঞ্জের অনেকেই।
রূপগঞ্জ উপজেলার হাশেম ফুড কারখানায় ২০২১ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের প্রাণহানির ঘটনায় মালিক ও তার চার ছেলেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে সিআইডি। তবে অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে অভিযোগপত্রে কারখানার চার কর্মকর্তা এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দুই পরিদর্শককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলার হাশেম ফুড কারখানায় ২০২১ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের প্রাণহানির ঘটনায় মালিক ও তার চার ছেলেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে সিআইডি।
তবে অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে অভিযোগপত্রে কারখানার চার কর্মকর্তা এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দুই পরিদর্শককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তবে অভিযোগপত্রে মালিক ও তার চার ছেলেকে অব্যাহতি দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতদের স্বজনরা। সুযোগ থাকলে ওই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেয়ার কথা জানিয়েছেন। প্রয়োজনে নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে পুনরায় মামলার জন্য আবেদন করবেন বলেও জানান। ‘মালিকপক্ষের অবহেলা এতগুলো’ প্রাণহানি, এর শাস্তি মালিক না পেলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলেও মন্তব্য করেন ওই অগ্নিকাণ্ডে নিহত এক শিশুর পিতা।
২০২১ সালের ৮ জুলাই বিকেলে রূপগঞ্জ উপজেলার কর্নগোপ এলাকায় হাশেম ফুডস লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৫১ জন আগুনে পুড়ে মারা যান। আগুন থেকে বাঁচতে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান আরও তিনজন।
ঘটনার দু’দিন পর ১০ জুলাই রূপগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন ওই সময় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন মজুমদার। এই মামলার দুই বছর পর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। অভিযোগপত্রে ছয় আসামির বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে, যদিও মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে ওই সময় দায়ের করা হয়েছিল।
আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান। মামলায় কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তার চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহিম, তাওসীব ইব্রাহিম ও তানজিম ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেয়ার কথা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
তবে অভিযোগপত্রে কারখানাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহান শাহ আজাদ, উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাম প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন ও কারখানার প্রধান প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল) ওমর ফারুককে আসামি করা হয়েছে। ওমর ফারুক বাদে বাকি তিনজনের নাম মামলায় আসামির তালিকাতেও ছিল। এছাড়া অভিযোগপত্রে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক নেছার উদ্দিন ও সৈকত মাহমুদকেও আসামি করা হয়েছে ।
মামলার পাঁচ আসামিকে অভিযোগপত্রে বাদ দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন বলেন, তিনি বর্তমানে চট্টগ্রামে পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত আছেন। অভিযোগপত্র দাখিল এবং আসামিদের অব্যাহতির বিষয়ে তিনি অবগত নন। তাকে এই বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা কিছুই জানান নি।
‘কারখানার মালিক এতে দায় এড়াতে পারেন না বলে পুলিশ হত্যা মামলাটি দায়ের করেছিল। চার্জশিট পড়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।’ যোগ করেন তিনি।
তবে তদন্ত কর্মকর্তা মোকছেদুর রহমানের দাবি, তিনি তদন্তের ফলাফল বাদীকে জানিয়েই অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, তার আগেও তিনজন কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেছেন। তাদের পাওয়া তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত শেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগ এনে ছয়জনের বিরুদ্ধে বিচারের জন্য অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় কারখানার মালিকসহ পাঁচজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে মামলার বাদীসহ ৯১ জনকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করার কথাও জানান তিনি।
অভিযোগপত্রে হাশেম ফুড কারখানাটি নির্মাণ ও পরবর্তীতে উৎপাদন কার্যক্রম চলাকালীন নানা অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মূল নকশায় তিনটি সিঁড়ি রাখার কথা থাকলেও ৩৪ হাজার ৫০০ বর্গফুট আয়তনের কারখানাটিতে দু’টি সিঁড়ি রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মানা হয়নি কারখানার লে-আউটও। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছ থেকে শুধুমাত্র জুস তৈরির জন্য ছাড়পত্র নিয়ে সেখানে সেমাই, টোস্ট, জেলি, আচারসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি করা হতো। এমনকি কোনো অনুমতি না নিয়েই মালিকপক্ষ কারখানা সম্প্রসারণ করা হয়।
এছাড়া কারখানাটির নিচতলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ দাহ্য পণ্য মজুদ থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ কর্মী না রাখা ও শ্রমিকদের অগ্নিকাণ্ডের সময় করণীয় ব্যাপারে প্রশিক্ষণ না দেয়ার কথাও অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
প্রতিটি তলায় চারদিক ধাতব জাল দিয়ে ঘেরা ছিল, তাই আগুন লাগলে শ্রমিকরা মেঝে থেকে বের হতে পারেনি। যদিও ঘটনার সময় সিঁড়িও তালাবন্ধ ছিল। বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে আগুনটি প্রতিটি ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকরা সেই মুহূর্তে বেরোনোর কোনো বিকল্প খুঁজে পাননি এবং প্রাণ হারান। পুড়ে যাওয়া মৃতদেহগুলোর বেশিরভাগই শিশু। কারখানার মালিকরাও শিশুদের নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইন লঙ্ঘন করেছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, পুড়ে যাওয়া মৃতদেহগুলোর বেশিরভাগই শিশু। এতো অনিয়ম থাকার পরও কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়মিত পরিদর্শন ছাড়াই অসাধুভাবে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছিল।
তবে কারখানার মালিক ও তার চার ছেলের নাম বাদ দিয়ে সিআইডির তৈরি এই অভিযোগপত্রে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা।









Discussion about this post