রূপগঞ্জের এক সময়ের শান্তির জনপথ বরুনা গ্রাম এখন শোকের নগরীতে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার অজোপাড়া গা বরুনা গ্রামটি কেউ এতোদিন পুরো জেলাবাসীর কাছে তেমনভাবে পরিচিত না থাকলেও এবার সেই অবুঝ শিশু আয়ানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারাদেশে তোলপাড়ের সৃষ্টি হওয়ায় সকলের কাছে ব্যাপক সারা ফেলেছে ।
সেই বরুনা গ্রামের আয়ানের মায়ের কান্না এখন সকলের হৃদয়ে দাগ কেটে বিচারের দাবী জোড়দার হয়েছে । রাজধানীর অত্যান্ত সন্নিকটে কংক্রিটের নগরীর খুব কাছের গ্রামটিতে এখন নেই কোনো কোলাহল। বাজার থেকে ডানে বাঁক নিয়ে সামান্য এগোলেই শামীম আহমেদের বাড়ি। শান্ত গ্রামটির সর্বস্বান্ত এক বাড়ি, অসহায় এক পরিবার।
সম্প্রতি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলায় মারা যাওয়া ছোট্ট আয়ানের বাড়ি এটি। তার বাবা শামীম আহমেদ বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত। তার স্ত্রী রেহানা আক্তার গৃহিণী। শামীম-রেহানার দুই সন্তান। পাঁচ বছরের আয়ান বড় আর ছোট আট মাসের তাসফিয়া।
একমাত্র ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাড়িতে এখনো চলছে শোকের মাতম। বরুনাজুড়েই ছড়িয়েছে সে নীরবতা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ফুসফুসে বাতাস জমে যাওয়ায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে শিশু আয়ানের। এতে তার হার্ট, কিডনি, লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো বিকল হয়ে পড়ে।
আয়ানকে বরুনা কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ১১ দিন আগেই।
বাড়িতে ১১ দিন ধরেই হাজারো মানুষের ভিড়। সবাই পরিবারটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার চোখ মুছছে আড়ালে-বিরালে।
আবার কৌশলে কেউ কেউ ‘আয়ান আর ফিরে আসবে না । বিচার চেয়ে কি হবে ? এরা বিশাল বিশাল মানুষ ! বড় বড় ডাক্তার। তাদের হাত অনেক লম্বা । তাদের বিরুদ্ধে না গিয়ে মীমাংশার কৌসূলী প্রস্তাব ও নানাভাবে কৌসূলী হুমকি’ দিচ্ছেন কেউ কেউ। এমন মন্তব্য পরিবারের কারো কারো ।
শিশু আয়ানের মৃত্যুর ১১ দিন পর আজ বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারী) বরুনা বাজারে গিয়ে আয়ানদের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে এগিয়ে আসেন কয়েকজন যুবক। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘মুসলমানি করাতে গিয়ে মারা গেছে যে, সেই আয়ানদের বাড়ি যাবেন ? আসেন, পথ দেখাতে গিয়ে আক্ষেপের সুরে বলেন, খেলাধুলা আর দুষ্টামিতে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখত দুরন্ত আয়ান। ছেলেটার মৃত্যুতে এলাকা নিশ্চুপ হয়ে গেছে ! মনে হচ্ছে, গ্রামটা জনমানবশূন্য।’ বাড়ির আঙিনায় পৌঁছানোর আগেই কানে ভেসে আসে কান্নার রোল। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে আয়ানের খেলনা গাড়ি। নীল-সাদার মিশ্রণের তিন চাকার গাড়িটি পড়ে আছে অবহেলায়। খেলার সঙ্গী যে নেই। শোবার ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আয়ানের বইখাতা। তখনো মায়ের কোলে খেলছিল আদরের ছোটবোন তাসফিয়া।
আয়ানের মা জানান, তাসফিয়ার জন্মের পরও মায়ের কোলে ভাগ বসাত ছোট্ট আয়ান। কিন্তু একসময় ছোট্ট বোনকে আপন করে সেই দাবি ছেড়ে দেয় বড় ভাই আয়ান। এখন সেই দাবি চিরতরে ছেড়ে গেছে অজানায়। তাসফিয়া বুঝতেও পারবে না কতবড় আপনজন হারাল সে। যদিও মায়ের আর্তনাদে সে-ও মুখ ভাড় করে রেখেছে। ঘরভর্তি অচেনামুখের ভিড়ে হয়তো খোঁজে বেড়াচ্ছে চিরচেনা ভাইকে।
একমাত্র ছেলে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন রেহানা। বিড় বিড় করে বলেন, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন, এখন কে আমাকে সারাদিন ব্যস্ত রাখবে ? স্কুল থেকে ফিরে কে তাসফিয়াকে বলবে, লক্ষ্মী সোনা, চাঁদের কণা। রাগ করোনা এই তো আমি ! মা বলতে থাকেন, জানেন আয়ান সব সময় বলত, বড় হয়ে টিচার হবে, প্রিন্সিপাল হবে। বলত, আম্মু আমি তো বড় ভাই হয়ে গেছি। বোনকেও টিচার বানাব।
আয়ানের মা আরও বলেন, বাপজানকে (আয়ান) ভালো স্কুলে (জলসিঁড়ি ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ) দিয়েছিলাম। শিক্ষকরাও বলতেন, ছেলে আমার খুব মেধাবী; তবে একটু চঞ্চল।
গত বছর তাসফিয়ার জন্মের পর বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম। তাই গত জানুয়ারিতে ভর্তি করাতে পারিনি। তার পরও দুই টার্ম পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে আয়ান। নতুন বছরে প্লে থেকে নার্সারিতে ওঠে। গত ১৩ ডিসেম্বর স্কুলে ভর্তিও করি নার্সারিতে। পরে ভাবলাম, নির্বাচনের কারণে ক্লাস শুরু হতে দেরি হবে। সুন্নতে খতনা করাই। ভালো ও নিরাপদ সেবার আশায় ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখেন, তারা আমার বুকের মানিকরে মেরে ফেলল ! কার জন্য বাঁচব।
এ সময় অভিযোগ করে তিনি বলেন, চিকিৎসার নামে আমার সন্তানকে খুন করেও তাদের (ইউনাইটেড হাসপাতাল) লজ্জা হয়নি। বারবার ফোন দিতো বিলের পৌনে ৬ লাখ টাকার জন্য। তারা চিকিৎসক না, কসাই। কখনো শুনছেন খতনা করাতে এত টাকা বিল হয় কিংবা কারও মৃত্যু হয়েছে ?
আয়ানের চাচা লিটন ঢাকা বরিশাল রুটে লঞ্চে কর্মরত। তিনি বলেন, একটা ফুটফুটে শিশুর সঙ্গে কেউ এমন অবিচার করে কীভাবে ? নামি হাসপাতালে গেলাম; কিন্তু সেখানে গিয়ে সন্তানকেই হারাতে হলো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হত্যার বিচার চাই। কারও সঙ্গে যেন তারা আর এমন অন্যায় করতে না পারে।

এদেকে সন্তান হারিয়ে বিচারের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সন্তান হারানো শোকে পাথর বাবা শামীম আহমেদ। বিচারের দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগপত্র দেন তিনি। সে সময় মহাপরিচালক তাকে তদন্তসাপেক্ষে ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ ডিসেম্বর খতনা করতে আয়ানকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যান বাবা শামীম আহমেদ। পরদিন শিশুটির দেহে খতনা-পূর্ব অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়। এর আট দিন পরও জ্ঞান ফেরেনি আয়ানের। গত রোববার (৭ জানুয়ারী) রাত ১১টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসায় ব্যয় ধরা হয় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকা।
আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকার সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। খতনা করাতে গিয়ে আয়ান আহমেদ নামে এক শিশুর মৃত্যুর পর রোববার (১৪ জানুয়ারী) সন্ধ্যায় এ নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর বলছে, আয়ান আহমেদ (৫) নামের এক শিশুর মৃত্যুর পর তার বাবার করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তর হাসপাতাল পরিদর্শন করে। নিবন্ধন ও লাইসেন্স না থাকায় হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলো ।হাসপাতালটি পরিদর্শন করা হয় জানিয়ে অধিদপ্তর বলছে, এ সময় কর্তৃপক্ষ লাইসেন্স দেখাতে ব্যর্থ হয়। এমনকি নিবন্ধন বা লাইসেন্স পেতে প্রতিষ্ঠানটি কখনো আবেদনই করেনি। তাই পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো।
এমন মৃত্যুর ঘটনায়, খৎনার জন্য হাসপাতালে অজ্ঞান করা পাঁচ বছরের শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে কেন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। সেই সাথে শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া সারাদেশের কতগুলো অনিবন্ধিত হাসপাতাল আছে তার তালিকা ১ মাসের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে।









Discussion about this post