কে এই রানা ? রানার গডফাদার কে ? খোদ জেলা প্রশাসনের দপ্তর থেকে এই রানা ও তার গডফাদারের নাম মুখে আনার সাহস করছে না কেউ। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাও রানার পরিচয় প্রকাশ করতে ভয়ে হাত পা কাপা শুরু করেছেন।
এই রানার কোন ক্লু ও দতে অপরাগতা প্রকাশ করছেন অনেকেই । তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে বলেছেন, ‘সেই ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল সোমবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ফতুল্লার থানার পাগলাস্থ মেরী এন্ডারসনে অভিযান চালিয়ে মদসহ গ্রেপ্তার ৭০ জনেকে গ্রেফতার করেন পুলিশ । তৎকালীন সময়ে জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের (বর্তমান ডিআইজি) নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) সুবাস চন্দ্র সাহার নেতৃত্বে জেলা গয়েন্দা পুলিশ ও ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ এই অভিযানে অংশ নেয়। ওই অভিযানে ৮১ কার্টন বিদেশি বিয়ার (প্রতি কার্টন ২৪টি ক্যান) এবং চার কার্টন বিদেশি মদ (প্রতি কার্টনে ১০টি বোতল) উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় তোলপাড়ের সৃষ্টি হয় একটি নামকে কেন্দ্র করে। এই মদের প্রধান আসামী করা হয় জনৈক তানভীর আহমেদ টিটু কে। যার পিতার নাম অজ্ঞাত । ঠিকানা অজ্ঞাত। সেই টিটুকে হন্যে হয়ে গ্রেফতার করতে তৎকালীন এসপি (বর্তমান ডিআইজি) হারুন অর রশিদ যার-পর-নাই চেষ্টা চালায়। সেই টিটুকে খুঁজতে গিয়ে অনেক গণমাধ্যম কর্মী নাকানি চুবানীও খেয়েছেন। বন্ধ হয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রচারিত কয়েকটি অনলাইন নিউজ পের্টাল।
কিন্তু সেই টিটুকে আর খুঁজে (!) না পেয়ে জায়েদুল আলম (পিপিএম (বার) (২২তম) ব্যাচ বিসিএস ক্যাডার) ওই মদের মামলায় তানভীর আহমেদ টিটুকে ‘খঁজে পাওয়া নাই মর্মে’ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেই অজ্ঞাত টিটিুকে ঘিরে এবার ৪২ লাখ টাকার ঘুষকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বইছে নারায়ণগঞ্জে। বিগত সময়ে পুলিশ সুপার যেমন টিটুকে খঁজে পান নাই তেমনি বর্তমানে ৪২ লাখ টাকার ঘুষ কেলেংকারীর ঘটনায় রানাকে লুকিয়ে রাখতে যার-পর-নাই চেষ্টা চালাচ্ছেন জেলা প্রশাসন।’
নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে মুঠোফোনে বলেন, ‘সেই মদের টিটুকে খুঁজেন, তাইলে পেয়ে যাবেন ৪২ লাখ টাকা কার ? ওই রানা কে ? রানার বাবা একজন মিনি বাসের হেলপার ছিলেন, ওই রানা এখন নেতা !’
গত তিন দিন নানা তথ্য উপাত্ত ও অনুসন্ধ্যনের পর জানা যায়, সেই অজ্ঞাতনামা টিটুই এই অজ্ঞাত রানার গড ফাদার । সেই রানার বাবা একজন সামান্য মিনি বাসের হেলপার – ড্রাইভার হলেও এই অজ্ঞাত রানা ওই গডফাদার টিটুর বদৌলতে বিশাল কেলেংকারীর সাথে জড়িত।
ভূমি অধিগ্রহণে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তাদের সঙ্গে কোনো এক চেয়ারম্যানেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে, রানা নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে এই চেয়ারম্যানেরও সখ্যতা রয়েছে আবার এই চেয়ারম্যানও সেই হোয়াইট ক্রিমিন্যালের অনুগত ব্যক্তি ।
টাকার অঙ্কটা নেহাত কম নয়; ৪২ লাখ টাকা। সে টাকা আবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর থেকে উদ্ধার করা হয়। সে-ও আবার রাতেÑ এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার শেষ নেই। মানুষের প্রশ্ন বিপুল অঙ্কের এই টাকা কোথা থেকে আসলো অথবা কোথায় যাচ্ছিল। যদিও তদন্ত শেষে এই প্রশ্নের উত্তর দুদক কর্মকর্তারাই ভালো দিতে পারেবন বলে মনে করেন সচেতন মহল।
তবে, সাধারণ মানুষের আলোচনায় উঠে আসা কথাগুলো একদমই ফেলে দেওয়ার মত নয়। পাশাপাশি তাদের প্রশ্নও অযৌক্তিক নয়। সাধারণ মানুষ বলছেন, টাকাসহ আটকের পর জাহিদুল ইসলাম সুমন পালালো কীভাবে। এবং সুমন ‘রানা’ নামে যে ব্যক্তির নাম জানিয়েছিলেন সেই রানাকে কেন-ই বা আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়নি কেবল তার মৌখিক কথায় কেন বিশ্বাস করতে হবে যে এই টাকার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই’?
এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, মুন্সিগঞ্জ-পঞ্চবটি উড়াল সড়ক প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। এই সিন্ডিকেটে নিন্ম স্তরের ভূমির দালাল থেকে শুরু করে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিরাও রয়েছে। শোনা যায়, ‘হোয়াইট ক্রিমিন্যাল’ খ্যাত কোনো এক ব্যক্তি পর্দার আড়াল থেকে এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তার প্রতিনিধি হিসেবে তারই ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি রয়েছেন সামনের দিকে। যিনি ‘রানা’ নামে পরিচিত। তাই অনেকের প্রশ্ন, সুমন যে রানা নামের ব্যক্তির কথা বলেছেন সেই রানাই কী এই রানা !
এদিকে ভূমি অধিগ্রহণে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তাদের সঙ্গে কোনো এক চেয়ারম্যানেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও শোনা যায়। রানা নামে ওই ব্যক্তির সঙ্গে এই চেয়ারম্যানেরও বেশ সখ্যতা রয়েছে আবার এই চেয়ারম্যানও সেই হোয়াইট ক্রিমিন্যালের অনুগত ব্যক্তি বলেও শোনা যায়। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, সুমনসহ রানাকে আইনের আওতায় নিয়ে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ৪২ লাখ টাকার উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। এখন দেখা বিষয় দুদক কী করে।
তবে, ওই সিন্ডিকেটে গোড়া এতটাই মজবুত যে দুদকের হাত অত দূর পর্যন্ত যাবে কিনা, এ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বলা হচ্ছে, হোয়াইট ক্রিমিন্যাল এতটাই প্রভাবশালী ব্যক্তি যে, তাকে আটকের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জে সাবেক পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ। যার ভয়ে বাঘ ও মহীষ এক ঘাটেও জল খেয়েছিল। সেই তিনিও হোয়াইট ক্রিমিন্যালের মুখোশ উন্মেচন করতে পারেননি।
জানা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ক যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে তাদের কাজ অনেকটা মধ্যস্থতাকারির মত। ভূমি মালিকদের নাল জমিকে আবাসিক আর আবাসিক জমিকে বাণিজ্যিক দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়াই তাদের মূল কাজ। এ কাজের সঙ্গে রাজস্ব শাখার কিছু ব্যক্তিও জড়িত রয়েছে বলে শোনা যায়। যাদের মধ্যে অন্যতম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার কাওসার আহম্মেদ এবং সিদ্ধিরগঞ্জ রাজস্ব সার্কেলের আউটসোর্সিংয়ের সাবেক কর্মচারি জাহিদুল ইসলাম সুমন।
মূলত এই দুইজনের নেৃত্বেই জেলা প্রশাসন কেন্দ্রিক বিষয়গুলো তদারকি করা হতো। তাদের দুজনকে বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিতেন জনৈক রানা ও কথিত একজন চেয়ারম্যান। আর সার্বিক বিষয়ে পর্দার আড়াল থেকে এই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন ‘হোয়াইট ক্রিমিন্যাল’ খ্যাত ওই ব্যক্তি।
এদিকে সচেতন মহল বলছে, নারায়ণগঞ্জের বর্তমান জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন। ফলে এই চক্রটিকে সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর তাতে যদি তিনি সফল হতে পারেন তাহলে নারায়ণগঞ্জে তিনিও সাবেক পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদের মতো স্থায়ীভাবে ভালো কাজের স্বাক্ষর রেখে যেতে পারবেন। তবে, সিন্ডিকেটটি অত্যন্ত প্রভাবশালী। তিনি কতটা কুলোতে পারবেন সেটিই এখন দেখার বিষয়। একই সঙ্গে তারা বলেন, দুদক কর্মকর্তা যদি নিরপেক্ষভাবে তদারকি করেন এবং বিষয়টিকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন তাহলে ৪২ লাখ টাকার উৎস এবং এর সঙ্গে আরও যারা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন তাদের সামনে নিয়ে আসতে পারবেন।
তারা বলছেন, এই ৪২ লাখ টাকার সঙ্গে এক কাওসার এবং সুমনই নয়; বিশাল একটি সিন্ডিকেট এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই চক্রটি যে মুন্সিগঞ্জ-পঞ্চবটি উড়াল সড়কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তা সুষ্ঠু তদন্ত হলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। এ ক্ষেত্রে গোগনগর অঞ্চলে যাদের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের সঙ্গেও দুদক কথা বলতে পারে। এতে করে রানা এবং হোয়াইট ক্রিমিন্যালসহ কথিত ওই চেয়ারম্যান সম্পর্কে সকল তথ্যই বেরিয়ে আসবে।
প্রসঙ্গত, গত ১০ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ রাজস্ব সার্কেলের আউটসোর্সিংয়ের সাবেক কর্মচারি জাহিদুল ইসলাম সুমনের কাছ থেকে একটি কার্টন ভর্তি ৪২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক ওই টাকা জব্দ করার নির্দেশনা দেন এবং ফতুল্লা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এদিকে, সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি রানা নামে এক ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেন এবং ওই অর্থ রানা নামে ব্যক্তির বলে জানান। যদিও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রানা নামের ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি ওই অর্থের মালিক নন বলে জানিয়েছেন। পরে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী বাইন হীরার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জেলা প্রশাসন থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জব্দকৃত ৪২ লাখ টাকা দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট অর্থ এবং এর সাথে আরও ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে বিধায় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গত ১৪ই জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবর চিঠি দেন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক। পরে ১৬ জানুয়ারি দুদক কার্যালয়ে মামলা দায়ের হয় এবং ১৮ জানুয়ারি ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার কাওসার আহমেদকে গ্রেফতার করে দুদক।
নারায়ণগঞ্জের অসংখ্য ঘটনার নেপথ্যে এমন হোয়াইট কালার ক্রিমিনালদের দৌড়াত্ম মারাত্মক আকার ধারণ করলেও নারায়ণগঞ্জের আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্তারা যেমন জিম্মি তেমনি গণমাধ্যমকর্মীরা একদিকে মূখপাতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে । আবার কোন কোন গণমাধ্যম এমন টিটু – রানাদের খোঁজ নিতে গেলে তাদের নাজেহাল হতে হয় নানাভাবে। এই হোয়াইট কালার ক্রিমিনালদের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলেই কখনো কখনো হামলা মামলাসহ ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে অত্যান্ত কৌশলে। যার কারণে ব্যর্থতার পরিচয়ই দিয়ে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জে দায়িত্বপালনরত সরকারী আমলারা। আর এই নির্লজ্জ আমলাদের কারণে টিটুকে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় নাই তেমনি পাওয়া যাবেও না রানাকে ! অর্থাৎ টিটুর মতো রানাও রয়ে যাবে অধরা ই ।









Discussion about this post