বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামীলীগ সরকারকে ৫ আগষ্ট হঠানোর পর পোষাকখাতে ও ব্যবসায়ীদের চাঁদাবাজি যেন ওপেন সিক্রেট । হুমকিতে চাঁদা দিয়ে বিকেএমইএ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ও চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মোহাম্মদ মাসুদুজ্জামান প্রকোশ্যে ঘোষনা দেন, যারা চাঁদা নিয়েছেন এবার চাঁদা ফেরৎ দেন, নইলে প্রকাশ্যে এমন চাঁদাবাজির ঘটনা প্রকাশ করে চাঁদাবাজদের মুখোষ উম্মোচনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ থেকে বের করে দেয়া হবে বলে আল্টিমেটাম দেয় !
৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে সংগঠনটির নব নির্বাচিত সভাপতি মো. মাসুদুজ্জামান এবং বিকেএমইএ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের এমন হুমকির ২২ দিনের মধ্যে ফের হাতেম ও মাসুদুজ্জামান চাঁদা হিসেবে দেয়া সেই চাঁদার আট লাখ টাকা চাঁদাবাজদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে মর্মে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এমন কথা জানানো হলেও এ বিষয়ে এখনো রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা।
কারা চাঁদা নিয়েছেলো আর কিভাবে তা আবার চাঁদাবাজরা ফেরৎ দিলো সেই চাঁদাবাজির বিশাল অর্থ ? এ দিয়ে সৃষ্ট দোয়াশা ও নানা প্রশ্নের কোন ব্যাখ্যা না দেয়ায় উল্টো এমন বিষয়ে পুরোপুরিই দায়ী করে নগরীর অনেকেই বলেছেন, ‘হাতেম ও মাসুদুজ্জামান এই চাঁদাবাজির নাটক মঞ্চায়ণ করে নগরবাসীকে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করেছে । কারণ তারা বিগত আওয়ামীলীগ শাসনামলের ১৫ বছর পলাতক ওই কুখ্যাত অপরাধী চক্র ওসমান পরিবারের চাটুকার হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত । এখন তারা এই নাটক করে বোঝাতে চেষ্টা করছেন “হামছে বড়া কোন হ্যায় !”
এমন নৈরাজ্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে পোষাক শিল্পে অস্থিরতার সংবাদ প্রকাশ করেছে দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ । চাঁদাবাজি নৈরাজ্যের কারণে বিশাল এই শিল্পের বড় ধরণের ক্ষতির আশংকাও করেছে এই প্রতিবেদনে। এই ঘটনায় বিএনপির নেতাদের প্রতি ঈঙ্গিত দেয়া হলেও তাদের পক্ষ থেকে কোন বক্তব্যও পাওয়া যায় নাই।
সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অসন্তোষে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ছিল অস্থিরতা। সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলে বেতন বৈষম্যসহ বিভিন্ন দাবিকে শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে ব্যক্তিস্বার্থ, যা পোশাক খাতে নৈরাজ্য তৈরি করে। রাজনৈতিক দলের নামে বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যক্তিগত লাভের কাছে হুমকির মুখে পড়েছে তৈরি পোশাকের মতো দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী খাত।
দেশের তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। যার মধ্যে রয়েছে ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মালিকানার সমস্যা, শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা, কোনো কোনো জায়গায় বহিরাগতদের উস্কানি এবং শ্রমিকদের নতুন কিছু দাবিদাওয়া। বাংলাদেশ ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তারের মতে, শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির নেপথ্যে বহিরাগত প্রভাব কাজ করেছে। তিনি জানান, ঝুট ব্যবসা নিয়ে একটা সমস্যা; আগে যারা ছিল তাদের জায়গায় নতুন লোকজন এই ব্যবসা নিতে চায়। এ ছাড়া কিছু বহিরাগত সমস্যা ছিল। আর আন্তর্জাতিক কিছুটা চাপ থাকেই। যারা চায় আমাদের দেশ থেকে এই শিল্পটা আরেক দেশে যেন চলে যায়।
সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুর এলাকায় প্রায় ৪১৭টি পোশাক কারখানায় দীর্ঘদিন অস্থিরতার কারণে বন্ধ ছিল। একই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করেছে নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে। তৈরি পোশাক খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী মহলটি তাদের রাজনৈতিক প্রভাবও কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এই বিষয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। সেখানে দেখা যায়, ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে।
তবে নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে অভিযুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ। তার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের কাছ থেকে সুবিধা দাবি করার অভিযোগ উঠেছে ।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মী ও শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে তার সম্পর্কে আরও অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জে কমপক্ষে ১৫টি কারখানা ও টেক্সটাইল মিলে তালা দিয়ে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করা হয়। এ ছাড়াও কমপক্ষে ৪০ ব্যক্তিকে মারধর, জখম, বাড়িঘর বা আসবাবপত্র ভাঙচুর, হত্যার হুমকি, বাড়িঘরে তালা দিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নে অবস্থিত একটি তৈরি পোশাক কারখানা মালিক জানান, চাঁদার টাকা দিয়ে আপাতত নিজের কারখানা রক্ষা করেছেন তিনি। তিনি আশঙ্কা করেন, চাঁদা না দিলে হয়তো শত কোটি টাকা মূল্যের কারখানাটিতে অগ্নিসংযোগ করা হতো।
বিএনপির কেন্দ্রীয় এই নেতাকে নিয়ে নিজ দলের নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও দ্বিধাগ্রস্ত। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়, দলের ভেতরে পদ বাণিজ্যসহ নানাভাবে প্রভাব বিস্তার তৈরির চেষ্টা করেছেন আজাদ। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ পাইয়ে দেওয়ার টোপ ফেলে আজহারুল ইসলাম মান্নানের কাছ থেকে চেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করেন। পরে সেই চেকের ছবি নানান গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লবিং ও অর্থের বিনিময়ে মনোনয়নও কেনেন। এরপর সেই মনোনয়নের প্রভাব খাটিয়ে নিজের দল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে পদ-পদবি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা। বিদেশে লোক পাঠানো, নিজের ব্যবসা থেকে মুনাফা ও সুদ দেওয়ার টোপও ফেলতেন বলে নানান গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়। তার ছোটভাই রাকিব এর আগে মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় গ্রেপ্তারও হন। এ নিয়ে দলীয় মহলে একাধিকবার অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
৫ আগস্ট পরবর্তী আড়াইহাজার উপজেলার সাতগ্রাম, কালাপাহাড়িয়া, দুপ্তারা, বিশনন্দী ও হাইজাদী ইউনিয়ন এবং গোপালদি ও আড়াইহাজার পৌরসভায় অবস্থিত কিছু নির্দিষ্ট শিল্পকারখানায় আজাদের উদ্যোগে একদল কর্মী তালাবদ্ধ করার অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক ব্যবসায়ী নিজ প্রতিষ্ঠান রক্ষার স্বার্থে আপসের মাধ্যমে কারখানা রক্ষা করেন। এ নিয়ে আজাদ নিজেই তার সোশ্যাল মিডিয়ায় তালা খুলে দেওয়ার একটি ভিডিও আপলোড করেন।
কথিত চাঁদা এবং সুযোগ-সুবিধা না দেওয়ার অসম্মতিতে আজাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন ফকির নিটওয়্যারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আখতারুজ্জামান, ফকির ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ এবং উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে জুন মাসে সংঘটিত একটি নিহতের ঘটনা আগস্ট মাসে দেখিয়ে ফকির আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়।
এ বিষয়ে ফকির গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার সুমন কান্তি সিংহ বলেন, ফকির নিটওয়্যার তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে পোশাক রপ্তানি করে আসছে। নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে গেল অর্থবছরের সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্যে এই শিল্পগোষ্ঠী অন্যতম। ব্যবসা ও অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন এমন একজন সিআইপিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে হত্যামামলার আসামি করা এবং অন্যান্য পরিচালকবৃন্দের সুনাম নষ্ট করা দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক বড় অশনিসংকেত। সরকারের উচিত তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা; দেশের ব্যবসা ও অর্থনীতি রক্ষা করা। এসব সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সচেতন থাকা উচিত। এসব বিষয়ে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, এমনকি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে নজরুল ইসলাম আজাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।









Discussion about this post