বন্দর উপজেলার অটোষ্ট্যন্ড নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিএনপির বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকার নিয়ন্ত্রিত দুই গ্রুপের ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে শুক্রবার ৮ জন আহত এবং শনিবার দুইজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আটক করা হয়েছে হান্নান বাহিনীর ৫ জনকে।
তবে জোড়া খুনসহ অসংখ্য আহতের ঘটনার নাটের গুরু ওসমানীয় দালাল সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপির বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকারকে গ্রেফতার করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়িসহ সম্ভাব্য স্থানে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
আটককৃতরা হলেন: নান্নু খলিফার পুত্র মো. শান্ত (২৫), আলমচানের পুত্র মো. রবিন (২৮), মো. সেলিমের পুত্র মো. সোহেল (৩০), মৃত দেলোয়ার হোসেনের পুত্র মো. কবির (৩৫), এবং কবির হোসেনের পুত্র মো. ফাহিম (২২)।
সেনাবাহিনী, র্যাব, ডিবি পুলিশ ও থানা পুলিশের কঠোর সতর্কতার পরও বিএনপির বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকার ও তার বাহিনীর ধারাবাহিক দ্বন্ধে শনিবার (২১ জুন) রাতে উপজেলার বন্দর রেললাইন ও পাশের শাহী মসজিদ এলাকায় এই ঘটনা ঘটে বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার।
এমন দ্বন্ধের শুরুতে শুক্রবার রাতে উভয় গ্রুপের নিয়ন্ত্রক সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপির বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকারকে যৌথ বাহিনীর কর্মকর্তারা সতর্কতা জারি করে পরিস্থিতি শান্ত করলেও আহত হন ৮ জন। একজন সিএমএইচ ও অপর একজন ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। আর ৬ জন আহত কে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।
ওই ঘটনার পর শনিবার রাতে যৌথ বাহিনীর সতর্কতা উপেক্ষা করে ফের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন বন্দর উপজেলার হাফেজীবাগ এলাকার প্রয়াত সাদেক আলীর ছেলে আব্দুল কুদ্দুস (৬০) এবং পাশের শাহী মসজিদ এলাকার প্রয়াত সাদেক আলীর ছেলে মেহেদী হাসান (৪২)।
শনিবার রাতে প্রতিপক্ষের হামলায় জোড়া খুনের ঘটনায় ব্যপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে বন্দরজুড়ে।
ছুরিকাঘাতে নিহত কুদ্দুস পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি কেউ কেউ তাকে পান দোকানী হিসেবে চিনেন অপরদিকে পাল্টা হামলায় নিহত মেহেদী বন্দর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। হামলাকারীরা সকল পক্ষ একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপির বহিস্কৃত নেতা হান্নান সরকার।
এমন লোমহর্ষক হামলায় জোড়া খুন ও আহত হওয়ার ঘটনায় পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় হান্নান সরকার। এই হান্নান সরকারের গ্রেফতারের দাবীতে মরদেহ নিয়ে মিছিল করে বন্দরবাসী।
জানা যায়, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও ইজিবাইক স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য (বহিষ্কৃত) হান্নান সরকারের অনুসারীদের মধ্যে কয়েকমাস ধরেই দ্বন্দ্ব ছিলো দৃশ্যমাণ। আর এই ধারাবাহিক দ্বন্দ্বের জেরে উভয়পক্ষের মধ্যে গত শুক্রবার ও শনিবার দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
হান্নান সরকার নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী রনি ও জাফর এবং অপর একটি পক্ষের নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন মেহেদী হাসান, বাবু সিকদার, বাবু ওরফে জুয়ারি বাবু ও শ্যামল। সম্প্রতি চুরির টিন বিক্রি নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে তর্কবিতর্কের পর গত শুক্রবারও এ নিয়ে তাদের দুইপক্ষের সংঘর্ষে ৭ (আট) জন আহত হন।
শনিবার ২১ জুন বিকেলে উভয়পক্ষ শাহী মসজিদ, বন্দর রেললাইন ও হাফেজীবাগ এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দেন। সন্ধ্যায় বন্দর রেললাইন এলাকায় আব্দুল কুদ্দুসকে সড়কের উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথারি কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
নিহত কুদ্দুসের সঙ্গে কারও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু তার ছেলে পারভেজ রনি ও জাফর গ্রুপের সদস্য। পারভেজকে খুঁজতে এসে না পেয়ে তার বাবাকে ছুরিকাঘাত করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এমন তথ্য নিশ্চিত করে পুলিশ ও নিহতের পরিবার।
নিহত কুদ্দুসের ছোটভাই দুদু মিয়া জানান, আমার বড় ভাই চায়ের দোকানে ছিলো। ভাইকে ডাইকা নিয়া পারভেজের কই জানতে চায়। পরে তারা ভাইরে এলোপাথারি ছুরি দিয়া আঘাত করে। ভাই নাকি বারবার তাগোরে কইছে, আমারে জানে মাইরো না। কিন্তু কিচ্ছু শোনে নাই হামলাকারীরা। আমরা লাশ গিয়া পাইছি হাসপাতালে।
বৃদ্ধ কুদ্দুসের মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনার এক পর্যায়ে অতিরিক্ত পুলিশও মোতায়েন ছাড়াও টহলে ছিল সেনাবাহিনী ও র্যাব।
রাত সাড়ে দশটার দিকে রনি ও জাফর গ্রুপের লোকজন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মেহেদী হাসানকে আটক করে একটি ক্লাবের সামনে পিটিয়ে গুরুতর যখম করে ফেলে রাখার পর রাত সাড়ে দশটায় তাকে উদ্ধার করে বন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা চিকিৎসক।
নিহত মেহেদীর ভগ্নিপতি সৌরভ জানান, বন্দরে যখন মার্ডারটা হয় তখন মেহেদী ছিল বাড়িতে। ও থাকতো অন্তত এক কিলোমিটার দূরে আমিন আবাসিক এলাকায়। মার্ডারের পর প্রতিপক্ষের লোকজনকে খুঁজতে গেলে রাস্তায় মেহেদীকে তুইল্লা নিয়া সিরাজউদ্দোল্লা ক্লাবে নিয়ে বেধরক মারে। বুকে, মাথা আর মুখমন্ডল একেবারে থেতলে দিছে। আমরা লাশ পাইছি হাসপাতালে।
নির্ভরশীল একটি সূত্র জানান, ‘প্রথমে বৃদ্ধ কুদ্দুস মিয়াকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কাউন্টার দিতে মাষ্টার মাইন্ডার ওসমান পরিবারের অন্যতম দালাল বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া সাবেক কাউন্সিলর হান্নান সরকারের তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় আরেকটা লাশ ফেলার নির্দেশনা পেয়ে প্রতিপক্ষের মেহেদী কে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। যেমনটি ঘটেছিলো আশির দশকে শহরের চাষাড়ায়। তারু সর্দারের পুত্র কামাল কে হত্যা করেছিলো শামীম ওসনানের অন্যতম সদস্য সারোয়ার, মাকসুদ, লালসহ অন্যান্যরা। এই কামাল হত্যাকাণ্ড কে কাউন্টার দিতে কালাম নামক এক চাষাড়ার বাসিন্দাকে হত্যা করে। এই দুই হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার আজো হয় নাই। তেমন ওসমানীয় পুরনো কায়দার কাউন্টার হত্যাকাণ্ড চালানো হয় হান্নান সরকার।’
অসংখ্য অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে হান্নান সরকারের মুঠোফোনের নম্বরে একাধিকবার কল করেও তার সংযোগ পাওয়া যায় নাই। মুঠোফোনে ম্যাসেজ পাঠালেও সাড়া দেন নাই হান্নান সরকার।
বন্দরে এমন জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) প্রত্যুষ কুমার মজুমদার।









Discussion about this post