নিজস্ব সংবাদদাতা :
চট্টগ্রাম–ঢাকা পাইপলাইন চালুর অল্প সময়ের মধ্যেই পদ্মা ও মেঘনা তেল কোম্পানিতে পাওয়া গেল ভয়াবহ ডিজেল ঘাটতি। যমুনার পর এবার আরও দুই রাষ্ট্রীয় কোম্পানির ডিপোতেও ‘গায়েব’ হয়ে গেছে প্রায় দেড় লাখ লিটার ডিজেল। প্রশ্ন উঠেছে—পাইপলাইন করার পরও তেল অদৃশ্য হয় কীভাবে ?
ডিপোতে পৌঁছেই উধাও!
বিপিসির হিসাব বলছে, ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে মেঘনার গোদনাইল ডিপোতে পাঠানো হয়েছিল ২৫.৩৭ লাখ লিটার ডিজেল। কিন্তু ট্যাংকে মাপা হলো মাত্র ২৪.২২ লাখ লিটার—অর্থাৎ ঘাটতি ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫১ লিটার।
পরদিন পদ্মার ডিপোতে পাঠানো ২৫.২০ লাখ লিটারের বিপরীতে পাওয়া গেছে ২৪.৯৩ লাখ লিটার। ঘাটতি ২৭ হাজার ৩০২ লিটার।
পাইপলাইনের দুই প্রান্তেই মিটার, সার্ভে টিম, তেলের চার্ট—সবই যখন বহাল তবিয়তে, তখন এমন বিপুল পরিমাণ ঘাটতি কীভাবে সম্ভব ?
প্রাচীন ‘ডিপস্টিক’ কৌশল: দুই মিলিমিটারেই মিলছে হাজার লিটার !
ডিপো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই বলছেন—ট্যাংকের গভীরতা মাপার রডে (ডিপ স্টিক) মাত্র ২ মিলিমিটার কম দেখালেই ১,১৮০ লিটার পর্যন্ত তেল ‘চুরি’ করা যায়। অথচ দেশজুড়ে ডিজিটাল অগ্রগতি চললেও রাষ্ট্রীয় জ্বালানি খাত চলছে সনাতনী ‘রড-নির্ভর’ ব্যবস্থায়।
যমুনার কেলেঙ্কারিও ছিল একই ধাঁচে
গত সেপ্টেম্বরে যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপোতে ‘গায়েব’ হয়েছিল প্রায় পৌনে চার লাখ লিটার ডিজেল। পরে দেখা যায়—ট্যাংকের সক্ষমতাই ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখানো হয়েছিল। ট্যাংক পুনঃযাচাইয়ের পর ধারণক্ষমতা ৭৭,৪৯২ লিটার বাড়ে।
অর্থাৎ—ক্ষমতা কম দেখিয়ে তেল চুরির পথ আগেই পাকা ছিল।
অজুহাতের বৃষ্টি, স্পষ্ট জবাব নেই
পদ্মা–মেঘনার কর্মকর্তারা বলছেন—
▢ “শীতে তাপমাত্রা কমায় ঘনত্ব কমে যেতে পারে।”
▢ “মিটারে ত্রুটি থাকতে পারে।”
▢ “পাইপলাইন এখনো পরীক্ষামূলক।”
প্রশ্ন হলো—একটি বহুমূল্য জাতীয় প্রকল্পে (ব্যয় বেড়ে ৩,৬৯৯ কোটি টাকা) বহু বছরের দেরির পরও কেন মিটার ত্রুটিপূর্ণ? আর প্রতিটি কোম্পানিতে একই সময়ে, একই ধরনের ঘাটতি—এ কি নিছক ‘ঘনত্বের খেলা’?
তেল কোথায় যাচ্ছে—কে দায় নেবে ?
বিপিসির চেয়ারম্যান বলছেন—অসাধু একটি চক্র পাইপলাইন চালুর পর “বিশৃঙ্খলা” সৃষ্টি করছে। কিন্তু কারা এ চক্র? এ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম কঠোর সমালোচনা করে বলেন— “জাহাজ থেকে পেট্রলপাম্প পর্যন্ত চুরি সর্বজনবিদিত। তাই পাইপলাইন করা হলো। কিন্তু এখনো তেল গায়েব হয় কী করে? ট্যাংকের সক্ষমতা কমানোর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হয়নি কেন? আগে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় চুরি হয়েছে, এখন কেন হচ্ছে?”
তদন্ত–নাটক ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতি
জ্বালানি সচিবের সভায় শ্রমিক সংগঠনের দৌরাত্ম্য কমাতে ‘নজরদারির’ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবার নতুন কমিটিও করা হচ্ছে। কিন্তু যমুনার তদন্ত প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ হয়নি; অপরাধীর নাম-পরিচয় কেউ জানে না; শাস্তি তো দূরের কথা।
এ অবস্থায় প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠছে—
রাষ্ট্রীয় তেল খাত কি চক্রের দখলে ?
ট্যাংক–মিটার সব ঠিক হবে, কিন্তু দায়ীদের কী হবে ?
পাইপলাইন প্রকল্প পরিচালক দাবি করেছেন—
“তেল কোথাও না কোথাও আছে, ধরা পড়বেই।”
কিন্তু জনগণ জানতে চায়—
দেড় লাখ লিটার ডিজেল ‘কোথাও থাকা’র মানে কী ?
এ তেল কি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, নাকি কারও পকেটে যায় ?
উপসংহার : এখন সময় কঠোর শাস্তির ও স্বচ্ছ তদন্তের
একদিকে ৩,৬০০ কোটির পাইপলাইন, অন্যদিকে দেড় লাখ লিটারের গায়েব তেল—এ যেন অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও লুকোচুরির এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি।
কঠোর, স্বার্থ–সংঘাতমুক্ত তদন্ত কমিটি এবং দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় না আনলে—
পাইপলাইন যতই আধুনিক হোক, তেল ততই গায়েব হবে—ট্যাংকের ভেতরে, রডের মাথায়, আর ক্ষমতাশালীদের ছত্রচ্ছায়ায়।







Discussion about this post