প্রধান প্রতিবেদক :
সাম্প্রতিক জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়নে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠলেও নারায়ণগঞ্জকে ঘিরে বিতর্ক যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা-বিচারের ঘাটতি ও অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযোগ এবার স্পষ্ট রূপ পেয়েছে। যোগ্য ও পরিশ্রমী কর্মকর্তারা বছরের পর বছর বঞ্চিত থাকলেও ক্ষমতাকেন্দ্রের নিকটবর্তী একটি বিশেষ গোষ্ঠী বারবার ‘গুরুত্বপূর্ণ জেলা’ হিসেবে নারায়ণগঞ্জকেই পাচ্ছে।
পরপর গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পদায়ন—কার যোগ্যতায়, কার ছায়ায় ?
২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিয়া—তাঁর নাম এখন ‘প্রশাসনিক সুবিধাভোগীদের তালিকার’ শীর্ষেই। রাজবাড়ী, নারায়ণগঞ্জের পর এবার চট্টগ্রামে ডিসি। অতীতে প্রভাবশালী সচিব আব্দুস সামাদের একান্ত সচিব থাকা এবং কয়েকজন শীর্ষ আমলার কাছে মৌখিক নির্দেশে দায়িত্ব পালন করা—সব মিলিয়ে প্রশাসনের ভেতরে তাঁর পদায়নকে অনেকে দেখছেন “সিন্ডিকেটের সরাসরি কদর” হিসেবে।
নারায়ণগঞ্জের এক সাবেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এ জেলায় ডিসি হওয়া মানে রাজনৈতিক–প্রশাসনিকভাবে শক্ত জায়গায় প্রবেশ। যারা প্রভাবশালী সচিবদের ঘনিষ্ঠ, তারাই এখানে আসে। যোগ্যরা নয়।”
বিতর্কিতরাও বঞ্চিতদের টপকে ‘গুরুত্বপূর্ণ জেলায়’
একই ব্যাচের শারমিন আক্তার জাহান—নড়াইলের ‘ভুয়া জুলাই যোদ্ধা’ বিতর্কের কেন্দ্রীয় চরিত্র। দুই দফা আবার ডিসি। এবার জনপ্রশাসন সচিবের নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নারায়ণগঞ্জে সহকারী কমিশনার (ভূমি) থাকাকালে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়মমাফিক ভোগ না করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২৭তম ব্যাচের তৌফিকুর রহমান তিন দফা ডিসি (কুষ্টিয়া–খুলনা–বগুড়া)। ২৫তম ব্যাচের আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনও একাধিক জেলা ঘুরে এসেছেন। নড়াইলের বর্তমান ডিসি ড. ছালামও দুই ধাপে দুই জেলা।
অভিযোগ উঠছে—এত ধারাবাহিকতা ব্যক্তি-দক্ষতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; এখানে প্রভাবের ‘অদৃশ্য হাত’ স্পষ্ট।
নারায়ণগঞ্জ: সিন্ডিকেট-নির্ভর পদায়নের ‘হটস্পট’ ?
প্রশাসনিক মহলে প্রশ্ন—
কেন নারায়ণগঞ্জেই বারবার ক্ষমতাশালী নেটওয়ার্কের পছন্দের কর্মকর্তাদের পাঠানো হয় ?
কারণ, নারায়ণগঞ্জ উচ্চঝুঁকির, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এবং শিল্প-বাণিজ্যের কারণে ব্যাপক প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্র। এখানেই নাকি সিন্ডিকেটের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়।
স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন,
“নারায়ণগঞ্জে ডিসি মানে প্রচুর ফাইল, প্রচুর অনুমোদন, প্রচুর নিয়ন্ত্রণ। সিন্ডিকেটরা তাই এই জেলায় নিজেদের লোক চায়।”
বঞ্চিতদের দীর্ঘশ্বাস—‘সিন্ডিকেট ভেঙে না দিলে জনপ্রশাসন ধ্বংস’
বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকা সিনিয়র কর্মকর্তাদের ক্ষোভ এখন তীব্র। অনেকে বলছেন—
“সমান ব্যাচের কিছু লোক তিন–তিনবার ডিসি, দুইবার ডিসি। আমরা ১০–১২ বছর ধরে কেবল অপেক্ষা করছি। যোগ্যতা নয়, সিন্ডিকেট–ঘনিষ্ঠতাই পদায়নের মাপকাঠি।”
জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্সের অভিযোগ: ‘এপিডি সিন্ডিকেটই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে’
সংস্থাটির অভিযোগ সরাসরি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দিকে। তাদের দাবি—এপিডি উইং একটি সংগঠিত সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে
নেতৃত্বে আছেন এক প্রভাবশালী যুগ্ম সচিব ও দুই উপসচিব
তারাই ইউএনও–ডিসি বদলি–পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করেন
আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পাঠানো হয়
৩৫তম ও ৩৬তম ব্যাচের ১৫৮ ইউএনওকে আকস্মিক প্রত্যাহার—সিন্ডিকেটের শক্তির প্রকাশ
এই অভিযোগ নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুস সবুর বলেন—
“একই গোষ্ঠীর একই মুখ গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ঘুরে ঘুরে যাবে—এটা স্বাভাবিক হতে পারে না। এতে প্রশাসনের ভেতরে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। সৎ কর্মকর্তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।”প্রশাসনিক আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জাহিদ রহমানের মতে—
“বাহ্যিক বদল হলেও ভেতরের সিন্ডিকেট অটুট থাকলে আগামী কয়েক বছরও প্রশাসন নিয়ন্ত্রিতই থাকবে। নারায়ণগঞ্জে যেভাবে ‘একইদের’ বারবার পাঠানো হচ্ছে—এটাই প্রমাণ।”
আসল প্রশ্ন—প্রশাসন কি সত্যিই বদলাচ্ছে ?
যতক্ষণ পর্যন্ত—যোগ্যতার স্বচ্ছ মূল্যায়ন না হবে, সিন্ডিকেট-নির্ভর ‘অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক’ ভাঙা না হবে, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ন্যায্য সুযোগ না দেওয়া হবে—ততক্ষণ নারায়ণগঞ্জসহ দেশের মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতার জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশ্ন এখন—
“ডিসি পদায়নে সিন্ডিকেটের ছায়া কাটবে কবে? আর ততদিন নারায়ণগঞ্জ কি বিশেষ সুবিধাভোগীদের পরীক্ষাগার হয়েই থাকবে ?”








Discussion about this post