চার দিন নিখোঁজ থাকার পর উদ্ধার চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার বলছেন, প্রকাশিত সংবাদের কারণেই তাকে ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং বেঁধে নির্যাতনও চালানো হয়েছিল।
তবে কোন সংবাদের কারণে কারা তাকে ধরে নিয়েছিল, সেই বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেননি তিনি। এই সাংবাদিক আরও বলেছেন, তাকে যারা ধরে নিয়েছিল, তারা অন্য সাংবাদিকদেরও শিক্ষা দিতে চেয়েছিল।
সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত গোলাম গোলাম সরওয়ার সিটিনিউজবিডি নামে একটি ইন্টারনেট সংবাদপত্রের নির্বাহী সম্পাদক।
সরওয়ার নিখোঁজ জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন আজকের সূর্যোদয়ের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান জোবায়ের সিদ্দিকী।
এরপর চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নও বিক্ষোভে নামে।
চার দিন পর রোববার রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা এলাকায় রাস্তার পাশে অজ্ঞান অবস্থায় সরওয়ারকে পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়।
পুলিশ সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এখনও তিনি হাসপাতালেই রয়েছেন।
সরওয়ারকে উদ্ধারের সময়কার একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে, যাতে আকুতি জানাচ্ছিলেন – “প্লিজ আমাকে মারবেন না, আমি আর নিউজ করব না।”
সরওয়ার বলেন, তাকে ধরে অজ্ঞাত একটি স্থানে নিয়ে শরীরে কাপড় জাতীয় কিছু একটা মুড়িয়ে কাঠের তক্তা ও বেল্ট দিয়ে মারধর করা হয়েছিল।
“চার দিনের মধ্যে দুই দিন তারা আমাকে মারধর করে। ‘আর নিউজ করবি কি না’ বলতে বলতে মারধর করে। পাশাপাশি বলতে থাকে- তোদের কোনো নিরাপত্তা নাই, তোরা কী করতে পারবি?”
কোন সংবাদের কারণে- জানতে চাইলে সরওয়ার বলেন, তা তিনি জানেন না।
পরিচয় না জানলেও মারধরকারীরা ‘প্রশিক্ষিত’ বলেই মনে হয়েছে তার কাছে।
সরওয়ার বলেন, মারধরের সময় ওই ঘরে থাকা লোকজন বাইরের কারও সঙ্গে ‘স্যার’ সম্বোধন করে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল।
“তারা বলছিল- ‘স্যার রাখব নাকি ফেলে দিব?’ অপর প্রান্ত থেকে বলে- ফেলতে হবে না, তারে দিয়ে অন্যদের থ্রেট দেওয়া দরকার, সে ‘তেনাফাডা সাংবাদিক’ তাকে কেন মারবি? তারে আনা হয়েছে সে বেশি উড়ছে সেজন্য।”
জোবায়ের সিদ্দিকীর জিডিতে সরওয়ারকে বৃহস্পতিবার থেকে পাওয়া যাচ্ছে না বলা হলেও সরওয়ার বলেন, বুধবার রাতে তাকে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
সরওয়ার বলছেন, চন্দনাইশ উপজেলায় নিজ বাড়িতে যাওয়ার জন্য বুধবার রাত ১২টার দিকে নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হন তিনি। বাস ধরতে শাহ আমানত সেতু এলাকায় যাওয়ার জন্য ১০০ টাকায় একটি ভাড়ায়চালিত মোটর সাইকেলে উঠেছিলেন। সেখানে আরেকজন লোক উঠে তাকে অজ্ঞান করে নিয়ে যায়।
“মোটর সাইকেলে করে যাওয়ার পথে পেছন থেকে আরেক জন লোক উঠে পড়ে। কিছু একটা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ফেলার পর অজ্ঞান হই। মোটর সাইকেল থেকে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স জাতীয় কোনো গাড়িতে করে আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়।”
একটি বাসায় নিয়ে চোখ বেঁধে মারধর করা হয় বলে সরওয়ার জানান।
তিনি বলেন, যে বাসায় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল, সেখানে চারজন ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আর অন্যরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছিলেন।
আটকে রাখা ঘর থেকে ট্রেনের শব্দ শোনার কথাও জানান তিনি।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন সোমবার বিকালে বলেন, গাড়িতে করে আনার সময় সরওয়ার কিছু তথ্য দিয়েছে।
“তার সাথে বেশি কথা বলা সম্ভব হয়নি। আমরা আবার হাসপাতালে যাচ্ছি কথা বলতে। তার বলা প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে তদন্ত হবে। আমরা কাজ শুরু করেছি। আগের করা সাধারণ ডায়েরি প্রত্যাহার করে নিয়ে সরোয়ারের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হবে।”
এদিকে সরওয়ারের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎকসরা একটি বোর্ড গঠন করেছেন।
বোর্ডের প্রধান ডা. আব্দুর সাত্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাতে এ বিষয়ে কথা বলেননি।
বোর্ডের সদস্য এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, সরোয়ারের অবস্থা স্থিতিশীল আছে। রক্তচাপও স্বাভাবিক। অভ্যন্তরীণ কোনো আঘাত আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হবে।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়: টিআইবি
চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার ‘প্রকৃত রহস্য’ উন্মোচনের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি।
সারওয়ারকে খুঁজে পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করলেও তাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মানতে নারাজ তারা।
সংস্থাটি বলেছে, গোলাম সারওয়ারকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনাটি স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে আরও একটি হুমকি।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের নিখোঁজ হওয়া এবং নির্যাতনের পর আধমরা অবস্থায় তাকে খুঁজে পাওয়া মোটেও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
“বরং মুক্ত সাংবাদিকতা তথা স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে চলমান হুমকি, ভয়ভীতি ও নির্যাতনের নিষ্ঠুর ধারাবাহিকতা মাত্র। গণমাধ্যমের সার্বিক অবস্থার প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে উঠেছে গোলাম সারওয়ারের আর্তনাদের মধ্য দিয়ে।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “নিয়মিত বিরতিতে সাংবাদিক নির্যাতন এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে হামলা-মামলার ঘটনা ঘটলেও, কঠোর আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে যথোপযুক্ত শাস্তির দৃষ্টান্ত কার্যত অনুপস্থিত, যা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি।
“বরং একথা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে, মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতা বিষয়ে সরকারের বারংবার উচ্চারিত কথামালা শুধুই ‘রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা’ মাত্র!”
সাংবাদিকদের উপর হামলা-মামলা ও নির্যাতন-নিপীড়ন এমনকি অপহরণ-গুমের মতো ঘটনা সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে না বলে মনে করছে টিআইবি।
(বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)









Discussion about this post