দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বন্ধ, দখলকৃত দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার, মন্দির, মঠ, গীর্জা, প্যাগোডায় হামলা বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে গণঅবস্থান ও বিক্ষোভ মিছিল।
মূল ব্যানারে এমনটাই লেখা ছিল।
আশেপাশের ছোট ব্যানারগুলোতেও একই বিষয় উল্লেখ ছিল।
কিন্তু কর্মসূচীতে সবাই উপস্থিত হলে মাত্র ১৫ মিনিটের ব্যবধানে বদলে যায় মূল ব্যানার।
বদলে যাওয়া ব্যানারে লেখা ছিল ‘দেওভোগস্থ ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দিরের সম্পত্তি জিউর পুকুর নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পরিবার কর্তৃক দখল ও আত্মসাতের চক্রান্তের’ কথা।
প্রথম ব্যানারে গণঅবস্থানের কথা উল্লেখ থাকলেও নতুন ব্যানারে ছিল মানববন্ধনের কথা। প্রথম ব্যানারে আয়োজক হিসেবে ছিল পূজা উদযাপন পরিষদের নাম তবে পরের ব্যানারে পূজা উদযাপনের পাশাপাশি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নাম ছিল।
বুধবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের এক কর্মসূচিতে এমনটা দেখা গেছে।
দুপুর পৌনে দুইটার দিকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি শেষ হয় বিকেল চারটার দিকে। পুরো সময় শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের একাংশ বন্ধ থাকায় যানজট দেখা দেয়। পরে বঙ্গবন্ধু সড়কে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
মেয়র আইভী ও তার পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে জিউস পুকুর দখলের পায়তারার অভিযোগ এনে স্মারকলিপিও প্রদান করেন হিন্দু নেতারা।
কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক।
প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি। জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি প্রদীপ কুমার সাহার সভাপতিত্বে স্থানীয়দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চন্দল শীল, সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. খোকন সাহা, মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অরুন দাস, সাধারণ সম্পাদক উত্তম সাহা, রিপন ভাওয়ালসহ পূজা উদযাপন ও ঐক্য পরিষদের বিভিন্ন উপজেলা ও থানা কমিটির নেতাকর্মীরা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার শিপন।
এই কর্মসূচির পুরো সময় জুড়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, তার প্রয়াত পিতা আলী আহাম্মদ চুনকা ও পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া হয়।
নগরীর দেওভোগে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জিউস পুকুর দখল ও আত্মসাতের চেষ্টা চলছে অভিযোগ করেন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তারা সরাসরি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তার পরিবারের লোকজনের দিকে আঙুল তোলেন। কর্মসূচি সারাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, হামলা বন্ধের দাবিতে হলেও তাদের বক্তব্যে ছিল মেয়র আইভী ও জিউস পুকুর প্রসঙ্গ।
বক্তারা বলেন, ‘দেওভোগ অবস্থিত লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর বিগ্রহ মন্দিরের সম্পত্তি জিউস পুকুর নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পরিবারের লোকজন দখলের চেষ্টা করছে।’ এ সংক্রান্ত একটি স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রদান করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে নাসিক মেয়র আইভী ও তার প্রয়াত পিতার সাথে জামায়াত নেতাদের সম্পৃক্ততারও অভিযোগ করা হয়।
তবে কেন্দ্রীয় দুই নেতা তাদের বক্তব্যে সরাসরি মেয়রকে নিয়ে কিছু বলেননি। তারা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সঠিক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘সার্বজনীন, দেবোত্তর, ওয়াক্ফ সম্পত্তির মালিক হচ্ছে জনগণ। কাজেই এই সম্পত্তি নিয়ে প্রভাব বিস্তার করা অন্যায়। যারা করছেন তাদের বিরুদ্ধে সারাদেশেই আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, ‘এই পূজায় দুর্বৃত্তরা কোন অপকর্ম করতে পারে নাই। যারা দেবোত্তর সম্পত্তি করছে তারাও এক প্রকার দুর্বৃত্ত। আমাদের সকলের দায়িত্ব এই সম্পত্তি দখলমুক্ত করা। এই দেশে দখলবাজের কোন অবস্থান নেই। তিনি যত বড় প্রভাবশালী হোক না কেন।’
স্থানীয় নেতৃবৃন্দদের মধ্যে যারা বক্তব্য প্রদান করেন তারা সরাসরি মেয়র আইভী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন।
চন্দন শীল বলেন, ‘জিউস পুকুর লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের সম্পত্তি। এটাকে দখল করা হচ্ছে। অথচ এই দখলদারদের মেয়রের চেয়ারে বসানোর জন্য ভোট দিতে আপনাদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ১৯৭৪ সালে এই জিউস পুকুরের জন্য পরাজিত হয়েছিলেন আলী আহাম্মদ চুনকা। সুতরাং ধরাকে সরা জ্ঞান করবেন না। আইনিভাবে লড়াই করতে আসেন। দখলের নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হুমকি দিবেন না। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এই ধরনের অনাচার করতে দেওয়া হবে না।’
খোকন সাহা বলেন, ‘নিজেকে দানবীর দাবি করে মসজিদ, মন্দিরের জায়গা দখল করলে আওয়ামী লীগ সহ্য করবে না। জিউস পুকুরের জায়গা দখল করেছেন মেয়র আইভী ও তার আত্মীয়-স্বজন। এই বিষয়টি আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাবো। হিন্দুর সম্পত্তি যারা দখল করেন তাদের অবশ্যই আমার নেত্রী নমিনেশন দেবেন না। রক্ত দিয়ে হলেও জিউস পুকুরের জায়গা রক্ষা করবো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পুকুর নিয়ে কথা বলবো।’ এছাড়া অন্যান্য নেতারাও মেয়র আইভীকে নিয়ে কথা বলেছেন। যদিও সারাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, হামলার বিরুদ্ধে ছিল কর্মসূচি। মূল স্লোগান ছিল ‘সাম্প্রদায়িকতা রুখো, বীর বাঙ্গালী জাগো’।
এসব কারণে এই কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুরুর মূল ব্যানার কিছুক্ষনের মধ্যে বদলে ফেলা নিয়েও কথা উঠেছে। অনেকে মনে করেন, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ইস্যুকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচি।
একই কথা বলেছেন সিটি মেয়র আইভীও। তিনি বলেন, ‘এই পুকুরের সাথে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এই পুকুরের মালিকানার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। পুকুর কোনো ইস্যু না। এটা একটা চক্রান্ত। সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্র শুরু হলো। বক্তারাই কিন্তু নিজেই আমাকে নমিনেশন না দেওয়ার অনুরোধ করেছে। সুতরাং বিষয়টা কিন্তু ক্লিয়ার।’
মেয়র আরও বলেন, কে বা কারা সুবিধা নেওয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকে দিতে চাচ্ছে। ৩৬ বছর আগেও আমার বাবার সাথে তারা এই ধরনের খেলায় মেতেছিল। সেই লোকগুলোই আবারও তাদের পুরোনো খেলায় মেতেছে। মিথ্যা অভিযোগ তুলে তো আর সত্যকে আড়াল করা যায় না।’
কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার শিপন বলেন, সারাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, অত্যাচার, হামলা ও সাম্প্রদায়িতকা রুখে দিতেই কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই কর্মসূচি। গণঅবস্থান ও বিক্ষোভ মিছিলই ছিল মূল কর্মসূচি। স্থানীয়ভাবে জিউস পুকুরের প্রসঙ্গে আলাদা ব্যানার করা হয়েছে। স্মারকলিপি প্রদানের বিষয়টি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ ছিল না বলেও জানান শিখন সরকার।
এমন ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মহল ছাড়াও সর্বত্র ই ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। পুরো নগর জুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।









Discussion about this post