নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জ যেন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে । আর শিমরাইল মোড় হচ্ছে অপরাধীদের অন্যতম স্থান । ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ এ মোড় চিটাগাংরোড হিসাবে পরিচিত। এ মোড়ে হাত বাড়ালেই চাঁদা পায় প্রভাবশালীরা।
এমন অপরাধী কার্যক্রম চালাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক অসাধু কর্মকর্তা / রাজনীতিবিদ ও বিশেষ পেশার কিছু দালালদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে প্রকাশ্যেই ।
ক্ষমতার দাপটে এ মোড় থেকে মাসে প্রায় কোটি টাকার মতো চাঁদা আদায় করা হয় এমন অভিযোগ উঠেছে সেভেন মার্ডারের প্রধান আসামী নূর হোসেনের চাচাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন দেলার বিরুদ্ধে।
সূত্রে জানা যায়, শিমরাইল মোড়ের ট্রাক টার্মিনালে প্রায় ৪০০ ট্রাক রয়েছে যেখানে প্রতিটি ট্রাক থেকে দৈনিক ১৮০ টাকা করে ৭২ হাজার টাকা, শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাশে শিমরাইল রাস্তায় প্রায় ২০০ ট্রাক থেকে দৈনিক ১৮০ টাকা করে ৩৬ হাজার টাকা, শিমরাইল ড্যানিসের রাস্তায় প্রায় ৫০টি ট্রাক থেকে দৈনিক ১৮০ টাকা করে ৯ হাজার টাকা, ডেমরা সড়কে প্রায় ১১০টি লেগুনা থেকে দৈনিক ১৫০ টাকা করে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা, অটো রিক্সা ও বেবি টেক্সি থেকে দৈনিক প্রায় ৩২০ টাকা করে ১২ হাজার টাকা, প্রায় ৫০টি সিএনজি থেকে দৈনিক ৫০ টাকা করে আড়াই হাজার টাকা, মেঘালয় পরিবহনের ১৫০ টি গাড়ী থেকে দৈনিক ৫০ টাকা করে সাড়ে সাত হাজার টাকা এবং শিমরাইল পরিবহনের ৩০ টি গাড়ী থেকে দৈনিক ৩০০ করে ৯ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে দেলোয়ার হোসেন দেলা ওরফে চাঁদাবাজ দেলু।
সূত্র আরও জানায়, দেলোয়ার হোসেন দেলা শিমরাইল টার্মিনালে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছে। টাকা না দিয়ে কেউ এখানে ব্যবসা করতে পারছে না। নুর হোসেনের সাত খুনের কথা মনে করেই মানুষ মুখ বুজে টাকা দিয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তার সাথে ভিড়তে শুরু করেছে। সেই পুরোনো মাফিয়া জগত আবারও গড়ে উঠতে চলছে।
চাঁদাবাজ দেলু দীর্ঘদিন ধরে ট্রাক, বাস, লেগুনা, বেবিট্যাক্সি, টেম্পো, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন। শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে ইজারা ছাড়াই প্রতিটি ট্রাক থেকে রশিদবিহীন ৫০ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। বাস-মিনিবাসেও নেই কোনো ইজারা। শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির নামে আরও ৩০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। এভাবে প্রতিদিন শিমরাইল মোড় ও ট্রাকস্ট্যান্ডে পরিবহনে চাঁদাবাজি হচ্ছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও অঙ্গদলের কতিপয় নেতাকর্মীরা আড়ালে থেকে তাদের নিয়োজিত লোক দিয়ে এ চাঁদা উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
শিমরাইল টার্মিনালের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিটি গাড়ি স্ট্যান্ডে ঢুকলেই তাকে দিতে হয় ৫০ টাকা করে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩শ গাড়ি ঢুকে শিমরাইল টার্মিনালে। সিদ্ধিরগঞ্জের কথিত মামার ভাগ্নে দেলোয়ার হোসেন দেলা বর্তমানে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি শিমরাইল শাখার সভাপতি। সমিতির নামে সে জোরপূর্বক চাঁদা উঠিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। প্রতিদিন ২০ হাজার টাকা করে চাঁদা তুলছে। এ চাঁদার টাকা দিয়ে অন্তত ১০-১৫ জন সন্ত্রাসী লালন পালন করে আসছেন চাঁদাবাজ দেলু।
গত বছরের ৬ই ডিসেম্বর উক্ত সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: নোমান হোসেন টুটুল বাদী হয়ে দেলার এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ জেলা এসপি বরাবর একটি অভিযোগ দাখিল করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ডিসেম্বরের ১২ তারিখ সভাপতি দেলোয়ার হোসের দেলা এবং তার বাহিনী এ সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রাজা মিয়ার উপর হামলা করে এবং তাকে প্রাণনাশের হুমকী দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৭ তারিখ রাজা মিয়া সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় আরো একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
এছাড়া চাঁদাবাজ দেলু ২রা জানুয়ারী নাফ পরিবহনের ম্যানেজার মোঃ সুমনের নিকট পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরবর্তীতে ১৫ই জানুয়ারী রাত ৯ টার দিকে শিমরাইল বাস স্ট্যান্ডে তার নিকট আবারও একই চাঁদা দাবি করলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। অত:পর তাকে এলোপাতাড়ি মারধোর করে খুনের হুমকী দেয় চাঁদাবাজ দেলু। তার বিরুদ্ধে ২৪ জানুয়ারী তািরখে একটি অভিযোগ দায়ের হয়।
চাঁদাবাজ দেলুকে চাঁদা না দিলে ট্রাক ড্রাইভারদের প্রাণনাশের হুমকী দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গতবছরের ২০ সেপ্টেবর ট্রাক ড্রাইভার মো: আলমগীর হোসেন তার এবং তার ট্রাক মালিকগনের নিরাপত্তা চেয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন। এ অভিযোগ দায়ের করার কথা চাঁদাবাজ দেলু জানতে পারলে তাকেও প্রাণনাশের হুমকী দেয়। পরবর্তীতে তিনি ৪ অক্টোবর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে চাঁদাবাজ দেলুর বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পায়রা পরিবহনের এক ড্রাইভার জানান, পায়রা পরিবহনের প্রায় ৬০-৭০টি মিনিবাস রয়েছে। চাঁদাবাজ দেলু প্রতিটি বাস থেকে দৈনিক ২০০ টাকা করে চাঁদা নেয়। চাঁদা না দিলে এই রুটে বাস চলতে বাঁধা দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে ভয়ভীতি দেখানো হয় বলেও জানান তিনি।
শিমরাইল এলাকার এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, সিদ্ধিরগঞ্জে নব্য নূর হোসেন চেয়ারম্যান হিসেবে দেলার আবির্ভাব। অন্যান্য চাদাবাঁজরা গা ঢাকা দিলেও বহাল তবিয়তে রয়েছে দেলোয়ার হোসেন দেলা। রহস্যজনক কারণে প্রশাসনও নীরব ভূমিকা পালন করছে। নুরের পদপদবী, চাঁদা উত্তোলন, সন্ত্রাসীদের লালন পালন, প্রভাব বিস্তারসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে দেলোয়ার হোসেন দেলা। সম্প্রতি সে ৩৬ লাখ টাকা ব্যায়ে প্রাইভেট গাড়ি কিনে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সে প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদেরকে ম্যানেজ করে চলে ফলে তার দৌরাত্ব দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে সম্পূর্ণ শিমরাইল ট্রাক টার্মিনাল তার কাছে জিম্মি।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: মশিউর রহমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজদের কোন ঠাই নেই। কেউ চাঁদাবাজী করলে অভিযোগ পেলে চাঁদাবাজদের গ্রেফতার করা হবে।









Discussion about this post