অক্টোবর মাস যেন শামীম ওসমানের জন্য কষ্টের মাস। ২০০১ সালে নিজ দল আওয়ামীলীগ থেকে পল্টি খেয়ে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে যোগদান করে মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন অস্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে জয়লাভ করেন।
২০০১ সালের ওই নির্বাচনে সারাদেশে গডফাদার হিসেবে তকমা লাগানো প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমানকে পরাজিত করে জয়ের মালা ছিনিয়ে নেন এই পল্টিবাজ হিসেবে পরিচিত নেতা গিয়াস উদ্দিন।
অক্টোবর ১, ২০০১ তারিখের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের রোষানলের কারণে রাতের আধারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শামীম ওসমানসহ তার সাথে রাজনীতিতে যুক্ত থাকা অনেকেই । পরে দীর্ঘদিন স্বপরিবারে পলাতক জীবন যাপন করে প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। পহেলা অক্টোবরের পর থেকে শামীম ওসমান বিদেশ অবস্থানকালে পলাতক জীবনে কতটা কষ্টে দিন অতিবাহিত করেছেন তার তথ্য তুলে ধরেছেন বিভিন্ন বক্তব্যে।
সংসদ সদস্য হিসেবে মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের সাথে পরাজয়ের ১০ বছর পর আবার সেই অক্টোবর মাসের ৩০ তারিখে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নিজ দল থেকে টিকেট না পাওয়া প্রার্থী ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভীর সাথে বিশাল ভোটের ব্যবধানে পরাজয় বরণ করেন প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমান ।
শামীম ওসমানের সেই পরাজয়ের ১০ বছর পূর্ণ হলো ৩০ অক্টোবর ৷ ২০১১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত সিটি নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সাধারণ মানুষ তো বটেই নির্বাচন কমিশনও হয়তো এই নির্বাচনটি আলাদা করে মনে রাখে ৷ এই নির্বাচনে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দেশের ইতিহাসের প্রথম নারী সিটি মেয়র নির্বাচিত হন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ৷
যা এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে নানা কারণেই এই নির্বাচন গুরত্বপূর্ণ। এটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থানীয় নির্বাচনের সবচেয়ে হাইভোল্টেজ নির্বাচন। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ তাকিয়ে ছিল এই নির্বাচনের দিকে। মিডিয়ার প্রচারণা আর নির্বাচনী নানা নাটকীয়তা এই নির্বাচনকে দিয়েছিল ভিন্নমাত্রা। ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত ছিল প্রতি মুহুর্তের উত্তেজনা। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেছিলেন বর্তমান মেয়র আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। নির্বাচনের উত্তাপ এতোটাই ছিল যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও দাবি ওঠে৷ যদিও সেনাবাহিনী মোতায়েন না করাসহ নানা ইস্যুতে অবশ্য বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার ভোট শুরুর মাত্র সাত ঘণ্টা আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু শুরু থেকেই মূল লড়াইটা ছিল আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যে৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেই নির্বাচনে জিতেই মেয়র আইভী নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শামীম ওসমানের একক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন। শামীম ওসমানকে লক্ষাধিক ভোটে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও শহরের কর্তৃত্ব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নেন ডা. আইভী। মূলত এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একচেটিয়া কর্তৃত্ব হারান। আইভীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী হার কিংবা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একচেটিয়া কর্তৃত্ব হারানোর সেই ক্ষত ভুলতে পারেননি শামীম ওসমান। মূলত তখন থেকেই শুরু হয় আইভী-শামীমের লড়াই। বহুবার তাদের এই দ্বৈরথ থামাতে দলীয় প্রধান অর্থ্যাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে ৷
২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর পর পর মেয়র পদে সেলিনা হায়াৎ আইভী, শামীম ওসমান ও তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচনের ঘোষণা দেন। একই দলের দুই হাই প্রোফাইল প্রার্থীর নির্বাচন ঘোষণায় শুরু হয় এই নির্বাচন নিয়ে নানান সমীকরণ ৷ নির্বাচনী মাঠে নানান আশঙ্কার গুঞ্জন বাড়তে থাকে৷ সেই সময় স্থানীয় কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছিল না। ৩ অক্টোবর মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন আওয়ামী লীগের আইভী ও শামীম ওসমান এবং বিএনপির তৈমুর আলম খন্দকার। একক প্রার্থী ঠিক করতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দফায় দফায় আইভী, শামীম ওসমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। মেয়র পদে ছাড় দিলে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য মনোনয়ন দেয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল সেইসব বৈঠক থেকে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সাথেও বৈঠক করেন দুইজন। ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দেখা করে জয়ের ব্যাপারে দু’জনেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে অনড় থাকেন। তাদের দু’জনেরই অনড় অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছিল, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে হয়তো এ সমস্যার সমাধান হবে। তবে শেষ পর্যন্ত ১৩ অক্টোবর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে আইভী, শামীম ওসমান কেউই প্রত্যাহার করেননি ।
ডা. আইভী তখন সদ্য বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছিলেন৷ ২০০৩ সাল থেকে তিনি নগরবাসীর পাশে রয়েছেন ৷ ফলে তার ভরসাস্থলও ছিল সাধারণ জনগণ৷ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনেও সেই জনগণের প্রতি ভরসা রেখেই আইভী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমার সঙ্গে আছে। আমি এই মানুষগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। কাজেই ভয়ভীতি, চাপ, সব উপেক্ষা করে আমি নির্বাচন করব।’
নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলে দেখা যায়, শামীম ওসমানের সাথে আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতা। সেইসময় তাঁর বড়ভাই ভাই নাসিম ওসমান মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টির সাংসদ ও আরেক ভাই ব্যবসায়ী নেতা সেলিম ওসমানও তাঁর পাশে। তবে এমন সময় আইভীর পাশে দাঁড়ান আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এসএম আকরাম, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের জেলা আহবায়ক নিজাম উদ্দিন, যুবলীগের সভাপতি আব্দুল কাদির, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাতসহ তৃণমূলের নেতারা৷ অন্যদিকে নগরীর সাধারণ মানুষেরও ব্যাপক সমর্থন ছিল আইভীর প্রতি। সেদিন আইভীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই নগরীর শুভবুদ্ধির সকল রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো৷
নির্বাচনের অল্প কিছু দিন আগে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ শামীম ওসমানকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেন। তাঁর সমর্থনে কেন্দ্রীয় নেতারা নারায়ণগঞ্জে ভোট চাইতে আসেন। এতে চাঙ্গা হন শামীম ওসমান শিবির। কিন্তু রণে ভঙ্গ না দিয়ে আইভী ঘোষণা দেন, দলের সমর্থন না পেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ তাঁর সঙ্গে আছে। জয়ের ব্যাপারেও জনগণের প্রতি শতভাগ ভরসার কথা জানান তিনি৷
নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আইভী কারচুপির আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাঁর সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন। আইভী অভিযোগ করেন, ‘মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী শামীম ওসমানের ভাই নাসিম ওসমান প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন ৩০ তারিখ সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই ফল ঘোষণা হবে এবং আইভী পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারবে। তাঁর সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে।` শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন বলে আইভী এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন, এমন গুজবও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু হাল ছাড়েন না আইভী। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
আগে থেকেই নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি করেছিলেন আইভীকে সমর্থন দেয়া সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের নেতারা। নির্বাচনের ২ দিন আগে সেনা মোতায়েনের গুঞ্জনও ছিল কিন্তু সেনা মোতায়েন করা হবে না বলে ঘোষণা এলে আইভী দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দেন, ‘আমি মাঠ ছেড়ে দেবো না। লক্ষ জনতাই আমার সেনাবাহিনী।’
৩০ অক্টোবর নির্বাচনের দিন ছিল উৎসবমুখর। কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটলেও নির্বাচন ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু। দুপুরের দিকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে আইভীর এক সমর্থককে শামীম ওসমান মারধরের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরও কঠোর হয়। ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, আইভী তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। সেলিনা হায়াৎ আইভী পান ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮। আর বিপরীতে শামীম ওসমান পান ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। ফলাফল ঘোষণায় যতই আইভী এগিয়ে যেতে থাকেন মানুষের ভিড়ও বাড়তে থাকে চাষাঢ়ায়। সেদিন রাতে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ শহরের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিলেন। বিজয়ী আইভীর প্রথম কথা ছিল, ‘এই জয় জনগণের জয়।’
স্বাধীন দেশে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েছিলেন আইভীর পিতা আলী আহম্মদ চুনকা। কিন্তু দল সমর্থন দেয় আরেক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী খোকা মহিউদ্দিনকে। খোকা মহিউদ্দিনের পাশে ছিলেন শামীম ওসমানের বাবা একেএম শামসুজ্জোহা। সেদিনের সেই নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন চুনকা। আর সবচেয়ে কম ভোট পেয়ে খোকা মহিউদ্দিন হন তৃতীয়। ৩৭ বছর পর নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আবার সেই আলী আহাম্মদ চুনকার মেয়ে আইভী দলের সমর্থন চেয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত সমর্থন দেয় শামীম ওসমানকে। আর বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আইভীও লড়েছিলেন জনসমর্থনকে ভরসা করে। চুয়াত্তর সালের নির্বাচনে নেতারা সবাই কাজ করেছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া মহিউদ্দিন খোকার পক্ষে। আর জনতা ছিল আলী আহাম্মদ চুনকার পক্ষে। এই নির্বাচনকে চুয়াত্তরের পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা৷ তারা বলছেন, আইভী বাপকা বেটি৷ বাবার পথ ধরেই অর্জন করেছেন দেশের প্রথম নারী মেয়রের খেতাব৷ এই বিজয় ছিল প্রবল ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে গণমানুষের রায়।
এমন অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের একজন প্রবীন আওয়ামীলীগ ঘরানার রাজনীতিবিদ তার নাম প্রকাশ না করার জন্য জোড়ালো অনুরোধ করে বলেন, “নারায়ণগঞ্জে প্রশাসন কে ব্যবহার করে কি করা যায় তার উদহারণ ইতিমধ্যে খুব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সাত খুনের মধ্য দিয়ে । তাই নাম প্রকাশ না করেই বলতে হচ্ছে, যারা পরাজিত হয় তাদের ক্ষোভ আর আক্রোশ কতটা ভয়ংকর তা যারা বুঝার তারাই বুঝেন । ইতিমধ্যেই অনেক কর্মকান্ডই টের পাওয়া যাচ্ছে কি হতে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে । আগামীতে আরো অনেক ঘটনা অপেক্ষা করছে নারায়ণগঞ্জ বাসীর জন্য।” এমন মন্তব্যের পর আবারো এই নেতা প্রতিবেদকের হাত ধরে করজোড়ে তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন ।









Discussion about this post