জামালপুরের গণি গোমেজ হত্যা মামলার শীর্ষ জঙ্গি সদস্য সালাউদ্দিন সালেহীনের ফাঁসি বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
এই মামলার অপর আসামি জঙ্গি রাকিব মারা যাওয়ায় তার আপিল অকার্যকর ঘোষণা করেছেন আদালত। জঙ্গি সালাউদ্দিন বর্তমানে পলাতক।
মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।
এর আগে কারাগারে থাকাবস্থায় ২০০৬ সালে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থা অস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্টে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন জঙ্গি সালাউদ্দিন।
২০১৫ সালে অন্য মামলায় হাজিরা দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তখন থেকে তিনি পলাতক।
২০০৪ সালে জামালপুরের গণি গোমেজকে হত্যা করেন জেএমবির জঙ্গিরা। ওই মামলায় ২০০৬ সালে সালাউদ্দিন ও রাকিবকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ওই বছরই ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল- ১ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে ফাঁসি বহাল রাখেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়।
এর আগে জঙ্গি রাকিব ২০০৬ সালে কাশিমপুর কারাগার থেকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয় বরাবর একটি চিঠি দেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “জজ কোর্ট হতে … আইনের মৃত্যুদণ্ড মানি না। হাইকোর্ট যদি আল্লাহর আইনে বিচার করে তবে আমার আপিল আল্লাহর আইনের নিকট। তাগুতি বা … কোনো কোর্টে আমি আপিল করব না।”
কেএই সালাউদ্দিন দূর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন :
গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ আদালতে নেওয়ার পথে গুলি ও বোমা হামলা করে ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিদের একজন সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলাতে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শূরা সদস্য সালাউদ্দিনের জঙ্গি হওয়ার পেছনেও রয়েছে নানা কাহিনী।
স্কুল জীবনে মেধাবী এ সালেহীন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই গা ভাসায় জেএমবির সঙ্গে। পরিবারের দেওয়া নাম সালেহীন সোহেল হলেও জেএমবির সদস্য হওয়ার পর নাম হয়ে যায় ‘সালাউদ্দিন’।
পরিচিতি:
মো. সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ও কামরুজ্জামান মতিন ওরফে আব্দুল মতিন জাকির। আপন দুই ভাই। বয়সের ব্যবধান মাত্র সাত বছর। মেধাবী ছাত্র হয়েও তারা এখন ভয়ঙ্কর জঙ্গি নেতা। পরিবারের সদস্যরা বুঝে উঠতে পারেননি লেখাপড়ার আড়ালে কখন যে তারা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বনে গেছেন জঙ্গি নেতা। পাড়া-প্রতিবেশীরা বিষয়টি চিন্তা করে রীতিমতো আঁতকে ওঠেন।
এলাকাবাসী ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দুই ভাইয়ের পরিবারের দিক থেকে। তাদের মতে, শায়খ আব্দুর রহমান জামালপুর, বাংলা ভাই রাজশাহী আর সালাউদ্দিন ও তার ভাই মতিন বন্দর তথা নারায়ণগঞ্জবাসীর ললাটে নতুন করে এক কলঙ্ক এঁকে দিয়েছেন।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এই দুই ভাই এখন দেশব্যাপী পরিচিত।
২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমানের ঘনিষ্ঠ জন ও পৃষ্ঠপোষক কামরুজ্জামান মতিন ওরফে জাকির এবং ২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকা থেকে সালাউদ্দিনকে আটক করা হয়।
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক মো. ইসরাইল হোসেন এক হত্যা মামলায় সালাউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এছাড়া ময়মনসিংহ আদালতে বোমা হামলার ঘটনাতেও সালাউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
সালাউদ্দিন ও মতিনের বাবা রফিকুল ইসলাম শহরের জনতা ব্যাংক কালীরবাজার শাখায় টাইপিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ার থানা টেঙ্গারচর এলাকায়।
১৯৯৮ সালের বন্যার পর রফিকুল ইসলাম বন্দরের ৫৮, এইচ এম সেন রোডে বাড়ি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এর আগে বন্দরে ভাড়ায় থাকতেন।
চার ছেলের মধ্যে তৃতীয় সালাউদ্দিন আর দ্বিতীয় মতিন। বড় ভাই শামসুজ্জামান শাহীন ঢাকার একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত।
এক নজরে সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন :
মো. সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিনের বয়স (৪০)। পরিবারের সদস্যরা তাকে ডাকতো সোহেল বলে। ১৯৯৭ সালে বাড়ির পাশের বন্দর বিএম ইউনিয়ন স্কুল থেকে মানবিক বিভাগে কৃষি বিষয়ে লেটার মার্কসহ ৬৬৩ নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। লেখাপড়াতে মেধাবী হওয়ায় সালেহীনকে ভর্তি করানো হয় ঢাকার তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সিভিল বিভাগে।
২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল র্যাবের হাতে আটকের পর সালাউদ্দিন জানান, ১৯৯৯ সালে সানির সঙ্গে পরিচয় হয় সালেহীনের। তখন সানি তাকে জেএমবি শায়খ আব্দুর রহমাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। শায়খ রহমানের সংস্পর্শ পেয়ে ক্রমশ দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠেন সালেহীন।
পরবর্তীতে তার নাম পরিবর্তন করে সালেহীন থেকে হয় সালাউদ্দিন। শায়খের কাছ থেকে তিনি বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন জঙ্গি প্রশিক্ষণ নেন এবং দক্ষ হয়ে ওঠেন। অল্পদিনেই একজন ভালো সংগঠক হিসেবে সালাউদ্দিন পরিচিত পান। পরে শায়খ আব্দুর রহমান তাকে শূরা কমিটির সদস্য মনোনীত করেন। তিনি বাংলাভাইয়ের চেয়েও পুরনো জেএমবি সদস্য।
শায়খ আব্দুর রহমানকে সিলেটের শাপলাবাগের বাসা তিনিই ভাড়া করে দেন। অনুরূপভাবে বাংলাভাইকেও তিনি ময়মনসিংহে অবস্থান করার ব্যবস্থা করে দেন। ২০০৬ সালের ১৭ মার্চ সালাহউদ্দিনকে গ্রেফতারের জন্য ১০ লাখ টাকার নগদ পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার।
২৪ এপ্রিল র্যাবের অভিযানে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকা থেকে আটক হন তিনি। তিনি ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ এবং ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক মো. ইসরাইল হোসেন এক হত্যা মামলায় সালাউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, জামালপুর জেলার শরিষাবাড়ী থানার হৃদয় রায় (ভিকটিম) খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। থানার শানারপোর গ্রামে ভিকটিম হৃদয় রায় গরিব মুসলমানদের অর্থের লোভ দেখিয়ে বায়োস্কোপের মাধ্যমে যিশুখ্রিস্টের জীবনী দেখাতেন এবং খ্রিস্টান ধর্মে উদ্বুদ্ধ করতেন।
হৃদয় রায়ের এ সব কর্মকাণ্ড শায়খ আব্দুর রহমানকে জানানো হলে তিনি তদন্তের নির্দেশ দেন। রিপোর্টে জানানো হয়, হৃদয় কাফের হয়ে গেছে। তাই, তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে হামজো নামে এক ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন সালাউদ্দিন এবং তার সহায়তায় হৃদয়ের ঘরে ঢুকে ছুরির আঘাতে তাকে হত্যা করেন। এ সব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সালাউদ্দিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।









Discussion about this post