ট্রেনের সাথে বাসের ধাক্কায় হতাহতের ঘটনায় গঠিত তদন্দ কমিটি কাজ শুরু করেছে । সোমবার ২৭ ডিসিম্বর বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসন কতৃক গঠিত তদন্ত কমিটরে সদস্যরা । এসময় তারা দোকানী, প্রত্যক্ষদর্শী ও আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলেন এবং বক্তব্য মোবাইল ফোনে রেকর্ড করেন তদন্ত কমিটির সদস্যগণ।
পরিদর্শন শেষে তদন্ত কমিটির আহবায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার জানান, ঘটনাস্থল দেখলাম, পর্যবেক্ষন করলাম, আমরা প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য শুনলাম । আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবো। দুর্ঘটনার কারণ, দুর্ঘটনাটা কেন হলো এর কারন উদঘাটনে তদন্ত কমিটি কাজ করবে।
পরবর্তীতে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে প্রতিরোধ করা যায়, এ ধরনের অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে সে লক্ষ্যে আমাদের সুপারিশ থাকবে।
অতিমাত্রায় ব্যস্ত নারায়ণগঞ্জ শহরের বাস টার্মিনাল সংলগ্ন ১নং রেলগেটে রেল লাইনের উপরে যানজটে আটকে থাকা আনন্দ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে (ঢাকা মেট্টো ব-১১-৪৩৭৪) ট্রেনের ধাক্কার ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৪ জনে দাড়িয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৭ ডিসেম্বর সোমবার ভোরে মেজবাহ উদ্দিন (৬৫) নামে ব্যক্তি মারা যান। তাঁর বাড়ি বন্দরের ঘারমোড়া এলাকাতে।
রোববার ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় এক নং রেল গেইট এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে ঘটনাস্থলে দুইজন ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে এক শিশুর মৃত্যু ঘটে। নিহত অপর তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
তারা হলেন, গাইবান্ধা জেলার মৃত যাত্রা রাম দাসের ছেলে ভট্ট রাম দাস (৫২), বন্দর উপজেলার মৃত মনছুর আলীর ছেলে আবুল কালাম (৭৩) ও সদর উপজেলার ২নং বাবুরাইল ব্যাপারী পাড়ার মোক্তার হোসেনের ছেলে রিফাত হোসেন (৯)। সকাল থেকে দুপুরে মধ্যে তিনজনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেজবাহ উদ্দিন মারা যায়। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। পরে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে।’
এছাড়া গুরুতর আহত ৭ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ও মনির নামে একজনকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে রাতেই চিকিৎসা নিয়ে জেনারেল হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যায় মনির।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সদর মডেল থানার ওসি শাহ জামান বলেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি নারায়ণঞ্জ স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। এসময় স্টেশনের অদূরে শহরের ১ নম্বর রেলগেইট এলাকায় যানজটের কারণে লেবেল ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ‘আনন্দ পরিবহনের’ একটি বাসকে ধাক্কা দেয় ট্রেনটি। এতে বাসটি ২০ থেকে ২৫ গজ দূরে ছিটকে পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায়। ওই সময়ে দুইজনের দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী নারায়ণগঞ্জ মেরিন ইনস্টিটিউটের ক্যাডেট খায়রুল ইসলাম জানান, ট্রেনের ইঞ্জিনের ৪টি বগির পেছনে রেললাইনের উত্তর পাশে দাড়িয়ে ছিলাম পারাপারের জন্য। ৬টার পরপর হঠাৎ ট্রেনটি থেমে যায়। ধারণা করা হয় তিন সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেনটি থামে। বিকল শব্দও হয়। পরে সামনে এগিয়ে দেখি লাইন থেকে একটি বাসকে ধাক্কা দিয়ে ২০ থেকে ২৫ গজ দুরে নিয়ে যায়। এরপর চারদিকে চিৎকার চেচাঁমেচির শব্দ। অন্ধকারে অনেক কিছু বুঝা যাচ্ছিল না। কোনমতে সামনে গিয়ে দেখি ২টা লাশ পড়ে আছে। এছাড়া একটা খন্ডিত পা পড়ে থাকতে দেখি। পরে খবর পেয়ে পুলিশ আসে।
মাথা ও মুখে রক্তাক্ত আহত গার্মেন্টস শ্রমিক আমেনা আক্তার জানান, তিনি নাস্তা নেয়ার জন্য যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আখের রসের মেশিন তার উপর ছিটকে পড়ে। এতে আহত হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কারা যেন তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের নারায়ণগঞ্জের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন বলেন, খবর পেয়ে আমরা উদ্ধার কাজ শুরু করি। ঘটনাস্থল থেকে ২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পা উদ্ধার করা হয়েছিল। পা বিচ্ছিন্ন ছেলেটি ঢাকা মেডিকেলে মারা গেছে। পরে আরো একজন নিহত হয়েছেন।
ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক: নারায়ণগঞ্জ শহরের এক নং রেল গেইট এলাকায় বাস ও ট্রেন সংঘর্ষের পর বন্ধ থাকা ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। সোমবার সকাল সাড়ে ৬টায় নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে ঢাকার কমলাপুরের উদ্দেশ্যে ট্রেনটি ছেড়ে যায়।
নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার সিএম আক্তার হায়দার বলেন, ‘রোববার ঢাকা থেকে ৫টা ২০ মিনিটে ট্রেনটি ছেড়ে আসে। ৬টা ৫ মিনিটে এক নং রেল গেইটে বাসের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। তীব্র যানজট থাকায় রেলক্রসিংয়ের ব্যারিয়ার ফেলতে পারেনি। এ সুযোগে বাসটি ট্রেন লাইনে এসে থেমে থাকে।’
তিনি বলেন, সংঘর্ষের পর লাইন ক্লিয়ার না থাকায় ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এতে এক জোড়া ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। রাত ১২টায় ট্রেন লাইন থেকে বাসটি সরিয়ে ফেলা হয়। এছাড়াও ট্রেন লাইন পর্যবেক্ষণ করে সকাল সাড়ে ৬টায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়।’ বাস ও ট্রেন সংঘর্ষে হতাহতরা পথচারী: বাস ও ট্রেন সংঘর্ষে নিহত এক শিশু সহ চারজন এবং আহত আরো ৭জনের কেউ বাস বা ট্রেনের যাত্রী না। সবাই ছিলেন পথচারী কিংবা আশে পাশের দোকানদার বলে জানিয়েছেন পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান বলেন, ‘নিহত ও আহত সকলেই পথচারী। কেউ ট্রেন বা বাসের যাত্রী না।’ নিহত ভট্ট রাম দাসের মেয়ে জামাতা স্বপন দাস বলেন, ‘আমার শ্বশুর মিষ্টি সন্দেশ বাসায় তৈরি করে রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করে। গতকাল সন্ধ্যায় সন্দেশের কাঁচামাল কিনতে দিগুবাবু বাজারে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই এ ঘটনা ঘটে গেল।’
তিনি বলেন, ‘রাত ১১টা পর্যন্ত বাসায় ফিরে না আসায় আমরা খোঁজ নিতে থাকি। পরে জানতে পারি ১নং রেল গেইটে ট্রেন ও বাসের সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু আমার শ্বশুর বাসের কিংবা ট্রেনের যাত্রী ছিল না। যার জন্য কোন খোঁজ নেয়া হয়নি। কিন্তু সকালে জানতে পারি সেখানেই শ্বশুর মারা গেছে।’
নিহত আবুল কালামের নাতি আনিছ আল ইসলাম বলেন, ‘আমার নানা একটি ভবনের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করতেন। সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাসায় ফিরে আসার সময় যানজট থেকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখনই ট্রেন এসে বাসকে ধাক্কা দিলে বাসটি এসে নানা সহ কয়েকজনকে ধাক্কা দেয়। এতেই ঘটনাস্থলে মারা যায় নানা।’
তিনি বলেন, ‘রাতেই আমাদের প্রতিবেশি কয়েকজন নানাকে চিনতে পেরে বাসায় জানায়। কিছুক্ষণ আগেই নানার লাশ দিয়েছে পুলিশ।’ রেলওয়ের দু’টি মামলা দায়ের: বাস ও ট্রেন সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে সংঘর্ষের ঘটনায় কাউকে আসামি করে এখনও কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। সোমবার সকালে ঢাকা রেলওয়ে থানায় ওই দুটি মামলা দায়ের করেন রেলওয়ে পুলিশ।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল হক বলেন, ‘ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতের ঘটনায় দুটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। রোববার রাতে ৩ জনের মৃত্যুতে একটি ও সোমবার সকালে ঢাকায় আরেকজনের মৃত্যুতে আরেকটি মামলা হয়েছে।’ সংঘর্ষের ঘটনায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন।
তদন্ত কমিটির পরিদর্শন : বাস ও ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনায় রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জেলা প্রশাসনের ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির আহবায়ক হিসেবে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার।









Discussion about this post