নাহিদ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির মামলা

২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে ২৭৫ কোটি ৩২ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে রাজধানীর লালবাগের নাহিদ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
তবে মামলার তিন মাস পার হয়ে গলেও ঘুমিয়ে পরেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। মামলার পর দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)’র পক্ষ থেকে রহস্যজনক কারণে ঝিমিয়ে পরেছে।
এমন সংবাদ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)’র দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাথে গোপন পরামর্শ অনুযায়ী সংবাদপত্রে বাংলাদেশ প্লাষ্টিক ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানানিয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে ।
প্রকাশিত সংবাদ থেকে আরো জানা যায়, এনবিআরের একটি সূত্র জানিয়েছে, লালবাগ বকশিবাজারের নাহিদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন এনবিআর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলা হওয়ার পরপরই নাহিদ এন্টারপ্রাইজের যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়ার কথা। কিন্তু গোপনে নাহিদ এন্টারপ্রাইজ এখনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নাহিদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন এবং তার ছেলে ফয়সাল হোসেন মিলে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আনোয়ার হোসেন স্বল্প শিক্ষিত বলে তার ছেলে ফয়সাল হোসেন পিতাকে না জানিয়েই নানাভাবে অবৈধ এ ব্যবসা করে যাচ্ছে বলেও নিশ্চিত করেছে নাহিদ এন্টারপ্রাইজের একাধিক কর্মচারী।
উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে –এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভ্যাট গোয়েন্দা দপ্তর অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। পরে এই অনুসন্ধানের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির কাছে জুলাই, ২০১৫ থেকে জুন, ২০২০ সময়ের ভ্যাটসংক্রান্ত দলিলাদি চেয়ে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি কাগজপত্র না প্রেরণ করে চিঠি দিয়ে বারবার সময়ে চেয়ে কালক্ষেপণ করে। প্রতিষ্ঠানটি দলিলাদি দাখিল করে তদন্তকাজে সহযোগিতা না করায় ১৭ জুন ভ্যাট গোয়েন্দা দপ্তরের উপপরিচালক তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ভ্যাটসংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায় যে মেসার্স নাহিদ এন্টারপ্রাইজ অন্যান্য বন্ডেড প্রতিষ্ঠান থেকেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর কারণে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকিসংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
তারা প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করেছে। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য দেখিয়েছে ২৯১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ টাকা।
জব্দ করা নথিপত্র খতিয়ে দেখা যায়, প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ছিল ১ হাজার ৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকা। যেখানে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৪৭ কোটি ৪৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৫৪ টাকার প্রকৃত বিক্রয়মূল্য গোপন করেছে। যেখানে অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ১৫৭ কোটি ১২ লাখ ৭ লাখ ৯৯৩ টাকা আদায়যোগ্য। মাসে ২ শতাংশ সুদ হিসাবে আরও ১১৮ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ২৪২ টাকা প্রযোজ্য। সব মিলিয়ে মোট ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ২৭৫ কোটি ৩২ লাখ ২ হাজার ২৩৫ টাকা। বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হওয়ায় স্পষ্ট হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরনের অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত হয়েছে।
তদন্তে প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা প্রাইম ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখা ও উত্তরা ব্যাংকের চকবাজার শাখায় দুটো ব্যাংক হিসাবে মোট ১ হাজার ৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়, যা অবৈধ বন্ডেড পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত বলে প্রমাণ মিলেছে বলেও ভ্যাট গোয়েন্দা জানিয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিমের বক্তব্য জানার জন্য কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
প্রসঙ্গত, নাহিদ এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা’র অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি নিয়মিত বিএনপির পার্টি ফাণ্ডে টাকা দিতেন। এসব বিষয়ে আনোয়ার হোসেনকে ফোন করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গিয়েছে । এছাড়া তার ছেলে ফয়সাল হোসেনের বিরুদ্ধেও জামায়াত-বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। তাকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি বলে এমন সংবাদ প্রকাশ করে গণমাধ্যম ।
উল্লেখিত সংবাদ প্রকাশের পর ভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদে বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হলে নারায়ণগগঞ্জের অনেক পলিথিন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে বলেন, এখন অপরাধীদের জয়জয়াকার চলছে সর্বত্র । আমাদের নাম প্রকাশ হলে এই আনোয়ার হাজি ও তার লোকজন তথ্যদাতাদের কি ক্ষতি করতে পারে তা অনুমানও করতে পারবেন না । নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ও মুক্তারপুরের ফ্যাক্টরীতেই শুল্কমুক্ত পলিথিনের দানা এনে নারাযণগঞ্জের খোলা বাজারে বিক্রি করে যাচ্ছে এই হাজী আনোয়ার চক্র। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় হাজী আনোয়ার হোসেনের প্লাস্টিক কর্ণসার্ণ ফ্যাক্টরী থাকলেও পরবর্তীতে সেই ফ্যাক্টরী মুক্তারপুরে স্তানান্তর করে সেখানেই রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে । আর এই হাজী আনোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন ফ্যাক্টরী থেকেই নিষিদ্ধ পলিথিনের দানার ব্যবসা হচ্ছে বলেও চাউর রয়েছে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীদের মাঝে।
নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ একজন পলিথিন ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “সম্প্রতি র্যাবের আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম তার ফেসবুকে বলেছেন -‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই অন্যায়’ । এমন স্ট্যটোসের পর এই পর সারওয়ারকে বিচারের আওতায় আনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ এর ৩(খ) বিধিতে বর্ণিত ‘অসদাচরণ’ এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিধিমালার ৪(২)(ক) বিধি অনুযায়ী তাকে ‘তিরস্কার’ সূচক লঘুদণ্ড দেয়া হয়েছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে ।
এমন ঘটনায় প্রমাণ করে অপরাধীরা কতটা ভয়ংকর ও শক্তিশালী । তাদের বিরুদ্ধে কথা বলাই অন্যায় । তেমনি হাজী আনোয়ার হোসেন সারাদেশের পলিথিন জগতের গডফাদার। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে নানা মামলার হামলার আশংকা করে কেউ মুখ খুলেন না। এই হাজী আনোয়ার তার ব্যবসার অন্তরালে কি করেন তা কে না জানেন ? কোন আইনশৃংখলা বাহিনীর কি অজানা আছে তার কুকর্ম । ভ্যাট কর্মকর্তা, ট্যাক্স কর্মকর্তা, বিভিন্ন গোয়েন্দা ছাড়াও আইনশৃংখলা বাহিনীর অনেক অসাধু কর্তাদের সাথে আনোয়ার হাজি ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের রয়েছে গোপন যোগাযোগ । পূর্ণঙ্গ তথ্য যাচাই করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা উদঘাটন করে অপরাধী এই চক্রের শাস্তি দিতে পারলেই আইনের শাসন প্রতিষ্টা পাবে । নাইলে অপরাধীরা আরো রাঘববোয়ালে পরিণত হবে ।









Discussion about this post