ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেড থেকে শত কোটি টাকা লোপাটে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তদন্ত চায় সাধারণ সদস্যরা।
বিগত আওয়ামীলীগ শাসনামলে শতবর্ষীয় এই ক্লাবটি থেকে শত কোটি টাকার বেশী হাতিয়ে নিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহাম্মেদ টিটু ও তার দোসররা।
এক অর্থে এই টিটু নিয়ন্ত্রণ করতো নারায়ণগঞ্জের অপরাধ সাম্রাজ্যের পঞ্চাশ শতাংশ সেক্টর। অর্থাৎ শামীম ওসমান ও অয়ন ওসমানের নিয়ন্ত্রণও করতো এই টিটু । টিটু কি পরিমাণ ভয়ংকর তার প্রমান অনেকেই দেখেছে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়ার দৃশ্য দেখে। এমন মন্তব্য করেন ক্লাবের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র।
এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি থেকেই আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বের হয়ে শহরে মহড়া দিয়েছিলেন টিটু ও তার অনুগামীরা।
যে কারণে ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পরে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা এই ক্লাবটিতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের পরে লুটপাট চালায়।
জানা গেছে, ১৩০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডে (সাবেক ইউরোপিয়ান ক্লাব) ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে।
তবে শামীম ওসমানের শ্যালক টিটু সভাপতি হওয়ার পর থেকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব চলতে থাকে স্বৈরাচারি পদ্ধতিতে সন্ত্রাসী কায়দায়। এই ক্লাবের সদস্যদের সকলেই এলিট শ্রেণির হলেও ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভায় তাদের কথা বলার কোন সুযোগ থাকতোনা।
কোন সদস্য যদি কোন অনিয়মের প্রতিবাদ করতে চাইতো তাহলে তার উপর নেমে আসতো অমানুষিক নির্যাতন। ধীরে ধীরে ক্লাবটি পরিণত হয় অপরাধীদের আখড়ায়।
এই ক্লাবের যেসব রুম গেস্টদের থাকার জন্য ছিল সেগুলোতে সারারাত ধরে চলতো জুয়া।
এছাড়াও ক্লাবের নামে মদ এনে সেগুলো বাহিরে বিক্রি করতো টিটু ও তার লোকজন। ক্লাব সভাপতি টিটুর নেতৃত্বে সহ সভাপতি বিপ্লব সাহা ওরফে রামু সাহা ও আমলাপাড়ার সুজিতের মাধ্যমে ক্লাবে লিকারের (মদ) ব্যবসা পরিচালনা করতো বলেও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯ সালে নারায়ণগঞ্জে এসপি হারুনের সময়ে টিটুর বিরুদ্ধে মদ ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। পরবর্তীতে এসপি হারুনের বদলী হওয়ায় সেই অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায়। টিটু ও তার অনুগামীদের অন্যায় অপকর্মের প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়ে ক্লাব সদস্যরা প্রায় সময়েই বেনামে চিঠি পাঠাতেন গণমাধ্যম অফিসসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে।
দীর্ঘদিন ধরেই নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের নানা অনিয়ম নিয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। শুধু নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের নতুন আধুনিক ভবন নির্মাণের কথা বলেই লোপাট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
ক্লাব মেম্বারদের নতুন আধুনিক ভবনের স্বপ্ন দেখিয়ে তানভীর আহাম্মেদ টিটুর নেতৃত্বাধীন কমিটি ২০১৮ সালে ১৪৩০ জন এবং ২০২১ সালে প্রায় ৩০০ জন এসোসিয়েট সদস্য বিক্রি করে। প্রতিটি মেম্বারদের কাছ থেকে ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। সর্বমোট ৬০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ক্লাব একাউন্টে জমা হয়। এছাড়াও এর আগে ক্লাবে ৭ কোটি টাকার এফডিআর ছিল। সর্বমোট এফডিআর হওয়ার কথা ছিল প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু কয়েক বছর আগে বার্ষিক সাধারণ সভায় বলা হয় ক্লাবে এফডিআর আছে ৩৪ কোটি টাকা। এছাড়াও ২০২২ ও ২০২৩ সালে আরো ৬০০ এসোসিয়েট মেম্বার নেয়া হয়।
যাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা নেয়া হয়। এভাবে প্রায় শতকোটি টাকার বেশী সংগ্রহ করা হয়েছিল যার বেশীরভাগ অর্থই ক্লাবের নতুন আধুনিক ভবন নির্মাণের নামে খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচী নারায়ণগঞ্জ শহরে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া ও ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে টিটু ও তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে। টিটু নারায়ণগঞ্জ ক্লাব থেকেই বের হয়েছিলেন। এসময় তার সঙ্গে সিনিয়র সহসভাপতি বিপ্লব সাহা ওরফে রামু সাহা ও সহ সভাপতি ভূমিদস্যুখ্যাত এস এম রানাসহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। যার মধ্যে টিটুর হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ সঙ্গীদের হাতে আধুনিক সব অস্ত্র ছিল। তারা সেদিন গোটা শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
যে কারণে গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডে ভাঙচুর ও ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। ক্লাবের নির্মাণাধীন ভবনের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে মদ-বিয়ার, চেয়ার টেবিল, এসি, ফ্রিজ কম্পিউটারসহ সকল মূলবান আসবাব লুট করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি ক্লাব সদস্যদের খাবারও লুট করা হয় এসময়। পরে রাতে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে আবারো আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্দরা।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব থেকে শত কোটি টাকা লোপাট এবং ক্লাবকে সন্ত্রাসীদের আড্ডাখানা তৈরীর তদন্ত চান ক্লাবটির সাধারণ সদস্যরা। বিগত দিনে নারায়ণগঞ্জে বহু আন্দোলন সংগ্রাম হলেও নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে কখনোই হামলার ঘটনা ঘটেনি। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ ক্লাবটি বিগতদিনে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের মিলনমেলা ছিল। কিন্তু টিটু ক্লাবের নেতৃত্বে আসার পরে লুটপাট আর মদ ব্যবসা জুয়া খেলা সহ নানাবিধ অপকর্মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল ক্লাবটি। যে কারণে এই ক্লাবের শত কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় জড়িত নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি তানভীর আহাম্মেদ টিটু, সিনিয়র সহসভাপতি বিপ্লব সাহা ওরফে রামু সাহা, সহসভাপতি এস এম রানা, সাবেক সভাপতি আসিফ হাসান মাহমুদ মানুসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি সাধারণ সদস্যদের। এছাড়াও অর্থ লোপাটের বিষয়ে দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনেরও হস্তক্ষেপ চাচ্ছেন সাধারণ সদস্যরা। ইতোমধ্যে ক্লাবটিকে পুর্নগঠন করার লক্ষ্যে ক্লাবটির সাবেক নেতৃবৃন্দ নানাভাবে উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু টিটু ও তার বাহিনীর সন্ত্রাসীপনার কারণে ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষীয় এই ক্লাবটির যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয় বলেই মনে করছেন সকলে।









Discussion about this post