নিজস্ব প্রতিবেদক :
চট্টগ্রাম–নারায়ণগঞ্জ পাইপলাইন চালুর উদ্দেশ্য ছিল চুরি ও অপচয় বন্ধ করা। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো পথে হাঁটছে। যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপোতে টুটুল নামের এক শ্রমিকনেতার ছত্রচ্ছায়ায় প্রায় পৌনে চার লাখ লিটার ডিজেল গায়েবের ঘটনা চাপা পড়ে যাওয়ার পর এবার একই ধাঁচে পদ্মা ও মেঘনা তেল কোম্পানিতে মিলেছে প্রায় দেড় লাখ লিটার ডিজেলের অস্বাভাবিক ঘাটতি।
এ যেন স্পষ্ট বার্তা—
পাইপলাইন এলেও অনিয়মের পাইপলাইন বন্ধ হয়নি। বরং আরও পাকা হয়েছে।
চুরির দৃশ্যপট একই: ‘গভীরতা কম দেখাও, তেল কম দেখাও’
ডিপো–সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের বেশির ভাগ ডিপোতে আজও সনাতনী ডিপ-স্টিক দিয়ে তেল পরিমাপ করা হয়।
মাত্র ২ মিলিমিটার গভীরতা কম দেখালে ১,১৮০ লিটার পর্যন্ত ডিজেল ‘অন্তর্ধান’ দেখানো যায়।
যমুনার ঘটনার তদন্তে উঠে আসা তথ্যও একই অভিযোগকে সমর্থন করে—
ট্যাংকের সক্ষমতা ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখানো হয়েছিল।
তদন্তে দেখা গেছে—
ফতুল্লার দুটি ট্যাংকের প্রকৃত ধারণক্ষমতা আগের চার্টে ৭৭ হাজার ৪৯২ লিটার কম দেখানো হয়েছিল।
অর্থাৎ শুরু থেকেই চুরির জন্য জায়গা তৈরি ছিল।
এবার পদ্মা ও মেঘনায়ও একই ধাঁচের ঘাটতি—
মেঘনায় ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫১ লিটার ডিজেল গায়েব
পদ্মায় ২৭ হাজার ৩০২ লিটার ডিজেল কম
যেখানে পাইপলাইন এমন ঘাটতির সুযোগই রাখে না।
অসাধু চক্রের ‘বেঁচে থাকার নতুন কৌশল’?
বিপিসি চেয়ারম্যান নিজেই সভায় স্বীকার করেছেন—
পাইপলাইন চালুর কারণে এক অসাধু চক্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।
এ বক্তব্যের ভাষ্যমতে স্পষ্ট— চক্রটি রাজনীতির ছায়াতলে দীর্ঘদিন ধরে খাতটি নিয়ন্ত্রণ করে। এখন পাইপলাইনে চুরি কঠিন হওয়ায় ভিন্ন কৌশলে নতুন ‘ঘাটতি নাটক’ সাজাচ্ছে।
টুটুলের মাধ্যমে যমুনার ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা হলেও
মূল হোতাদের শাস্তি হয়নি, বরং পুরো ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেছে।
পরিণতিতে অনিয়মকারীরা আরও শক্তি পেয়েছে।
আর সেই ধারাবাহিকতারই সর্বশেষ উদাহরণ—
পদ্মা ও মেঘনার বর্তমান ডিজেল ঘাটতি।
পর্যবেক্ষণ: তাপমাত্রা, মিটার ত্রুটি—নাকি পূর্বপরিকল্পিত অপারেশন ?
দুই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা ঘাটতি ব্যাখ্যা করছেন তিনভাবে—
1. শীতের কারণে তেলের ঘনত্ব কমে যায়
2. মিটারের সমস্যা থাকতে পারে
3. ট্যাংকের সক্ষমতা পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন
কিন্তু প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে—
মিটারে ত্রুটি থাকলে পাইপলাইনে কীভাবে বাড়তি তেল দেখা যায় ?
কেন প্রায় প্রতিটি ঘটনায় ট্যাংকের সক্ষমতা জালিয়াতি পাওয়া যায় ?
কেন ফতুল্লা, গোদনাইল—সব ডিপোতেই একই কৌশলের অনিয়ম ?
যমুনার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে চক্রটি কেন থামবে ?
বিপিসির অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের কথাই কি তাহলে সত্যি ?
ক্যাবের স্পষ্ট মন্তব্য : চুরি বন্ধই হয়নি—বরং ‘পদ্ধতি বদলেছে’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেছেন— “জাহাজ থেকে পাম্প পর্যন্ত চুরি সর্বজনবিদিত। পাইপলাইন হলো চুরি রোধে। তবুও গায়েব হয় কীভাবে? ট্যাংকের সক্ষমতা কমিয়ে যারা চুরি করেছে, তাদের শাস্তি কোথায়?”
বিশেষজ্ঞদের মতে—
চুরি থামেনি, শুধু পদ্ধতি পাল্টেছে।
আগে ট্রাক–শ্রমিক–ডিপো চক্র যুক্ত ছিল।
এখন যুক্ত হয়েছে উচ্চপর্যায়ের মিটার–ট্যাংক–চার্ট সিন্ডিকেট।
টুটুল কাণ্ড ধামাচাপা—আজকের অনিয়মের জন্মসূত্র !
যমুনার ফতুল্লা ডিপো থেকে টুটুলের মাধ্যমে প্রায় ৩.৭ লাখ লিটার ডিজেল গায়েবের ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও তদন্ত থেকে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রক্ষা পেয়ে যান।
পরিণতিতে পরিষ্কার বার্তা গেছে—চুরি করলে শাস্তি হয় না।
এটাই নতুন চুরির বড় উৎসাহ।
আজ পদ্মা-মেঘনায় ঘাটতি ধরা পড়লেও
এ চক্র নিশ্চিত—“কয়েকদিন পরে সব আবার চাপা পড়ে যাবে।”
—
উপসংহার : অনিয়মের পাহাড়, জবাবদিহির শূন্যতা—রাষ্ট্রীয় খাতে ‘অদৃশ্য লুট’ অব্যাহত
একদিকে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাইপলাইন,
অন্যদিকে ডিপো–মিটার–ট্যাংকের কাঠামোগত দুর্বলতা।
তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা সিন্ডিকেট।
ফলাফল—টুটুল কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি এখন ডিপো থেকে ডিপোতে ছড়িয়ে পড়ছে।
রাষ্ট্রীয় তেল খাতে চুরি রোধে যদি—
স্বার্থ–সংঘাতমুক্ত তদন্ত কমিটি,
ডিজিটাল পরিমাপ ব্যবস্থা,
দোষীদের দৃশ্যমান শাস্তি,
ডিপো স্বয়ংক্রিয়করণ
অবিলম্বে নিশ্চিত না হয়—
তবে আজকের দেড় লাখ লিটার ঘাটতি
কালকে মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে—
আর জনগণের টাকা দিয়ে পূরণ হবে সেই গহ্বর।







Discussion about this post