ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনিয়মিত মেডিকেল অফিসার ডা. মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সময় দেন নিজ মালিকানাধীন নারায়ণগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে। ২০১২ সালের ২৫ মার্চ উপজেলায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদানের পর থেকে সেখানে নিয়মিত অফিস করছেন না তিনি। কেবল বেতন তোলার দিন তাকে দেখা যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অক্টোবর মাসে অফিস চলাকালীন প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে তাকে ১৩ ও ২৩ তারিখ ছাড়া অন্য কোনো দিনই পাওয়া যায়নি। ওই সব দিনে তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে। তার মালিকানাধীন ওই হাসপাতালটি নারায়ণগঞ্জ শহরের আমলাপাড়ায় অবস্থিত। তার ব্যবহৃত ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) থেকে জানা যায়, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও কনসালট্যান্ট এবং নারায়ণগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে চিফ কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। ওই ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তার পদমর্যাদা সহযোগী অধ্যাপক।
নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট ডেক্স :
প্রাইভেট চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়মিত হলেও অধিকাংশ সময় অনুপস্থিত নিজ কর্মস্থল নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অথচ ভোগ করছেন সরকারি সকল সুবিধা । তুলেছেন বেতন ভাতা, উৎসব ভাতা সহ বাস ভাড়ার নাম করে ভ্রমণ ভাতাও ।
জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা হাওরের এক প্রান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চল চাতলপাড়। যেখানে বর্ষায় যেতে হয় নৌকায়। শুকনো মৌসুমে হেঁটে। সেখানে নেই বাস চলাচলের উপযোগী রাস্তাও। তবুও বাস ভাড়ার নাম করে নিচ্ছেন ভ্রমণ ভাতা। এর বিনিময়ে উপজেলাবসীর চিকিৎসাসেবা দিতে নিয়মিত নেই তার উপস্থিতি।
তবে আমলাপাড়া নারায়ণগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে নিয়মিতভাবেই পাওয়া যায় তাকে। দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছে নিজ বানিজ্য। অন্যদিকে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার (এমসিএইচ-এসপি) হিসেবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত। আট বছর ধরে নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলছেন তিনি।
অভিযোগ আছে, ২০১২ সালের ২৫ মার্চ উপজেলায় যোগদানের পর থেকে অফিস করছেন না বললেই চলে। তবে প্রতি মাসে একবার হলেও বেতন-ভাতা উত্তোলনের প্রয়োজনে আসেন এ উপজেলায়। গত অক্টোবরে অফিস চলাকালীন প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে তাকে ১৩ ও ২৩ তারিখ ছাড়া অন্য কোনো দিনই পাওয়া যায়নি। ওই সব দিনে তিনি অফিস করেন নারায়ণগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে।
আরো জানা গেছে, যোগদানের পর থেকে গত আট বছরে ৪৭ লাখ ৯৩ হাজার টাকা বেতন, উৎসব ভাতা বাবদ পাঁচ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। প্রায় ৫২লাখ ৯৩ হাজার টাকার সরকারী সুবিধা নিয়েও কর্মস্থলের প্রতি উদাসিন তিনি। বিভিন্ন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পরিদর্শনের ব্যয় দেখিয়েও তুলেছেন অনেক টাকা, যার একটি গত ৪ এপ্রিলে উপস্থাপন করা চাতলপাড় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পরিদর্শন।
পুরো অক্টোবর মাস অফিস চলাকালীন তাকে কেন অফিসে পাওয়া যায়নি জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে ডা. জাহাঙ্গীর জানান, তিনি অসুস্থ ছিলেন, ছুটি নিয়েছেন, তাই আসতে পারেননি। কবে ছুটি নিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, তিন-চার মাস আগে।
আর এমন অভিযোগের তথ্য নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে দৈনিক সমকাল । তথ্য আছে তিনি ছুটি নিয়েছেন নভেম্বর মাসের পাঁচ তারিখে, এটা জানালে তিনি এড়িয়ে যান।
নাসিরনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে কীভাবে এক সঙ্গে কাজ করছেন জানতে চাইলে ডা. জাহাঙ্গীর বলেন, আমি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত। কবে নিয়োগ পেয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, সেটা বাসায় গিয়ে কাগজপত্র দেখে বলতে পারব।
এ দুটি কাজের পর নারায়ণগঞ্জ চক্ষু হাসপাতালে কীভাবে সময় দেন জানতে চাইলে বলেন, এটি আমার নিজের হাসপাতাল। এ হাসপাতালে আমি বিকেলে সময় দিই। তার কর্মস্থল নাসিরনগর থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ১১০ কিলোমিটার, কীভাবে দুপুর ২টা পর্যন্ত নাসিরনগরে অফিস করে নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় ফিরে আসেন বিকেলের মধ্যে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকেও যান-এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না তার কাছ থেকে।
ডা. জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ থাকায় এর আগে (২০১৭-১৮ অর্থবছরে) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. নুরুল আলম (বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন) তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন বলে নিশ্চিত করেন জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপপরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম। তাতেও অবশ্য বদলায়নি কিছুই।
তার দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি সকাল ৯টায় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যাত্রা করে ১১টায় পৌঁছান চাতলপাড় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে। পরিদর্শন শেষ করে বাস ও পদব্রজে সন্ধ্যা ৬টায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফিরে আসেন। যেখানে রাস্তাই নেই সেখানে বাস এলো কোথা থেকে! চাতলপাড় থেকে হেঁটে নাসিরনগর উপজেলা সদরে আসতে সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েক, সেখানে বাসে করে আসতে কীভাবে তিন ঘণ্টা সময় লাগে ?
ডা. জাহাঙ্গীরের নামে করা এসব ভ্রমণ বিলের ভাতা উত্তোলনের ব্যাপারে জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপপরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম জানান, অর্থ বছরের শেষ দিকে সবকিছু যাচাই-বাছাই করার জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে না বলে আমরা অর্থ বরাদ্দ বিলে অনুমোদন দিয়ে থাকি। তিনি আরও জানান, ডা. জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের তদন্ত করবে কর্তৃপক্ষ।
গত ৪ এপ্রিল চাতলপাড় ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পরিদর্শনের বিষয়ে জানতে চাইলে চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নাদিরা আক্তার বলেন, জাহাঙ্গীর স্যার একটি ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এপ্রিল মাসে কয়বার চাতলপাড় পরিদর্শনে গিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপজেলা সদরে তথ্য আছে। আপনি চাইলে অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. অভিজিৎ রায় বলেন, আমি নাসিরনগর হাসপাতালে যোগদান করেছি প্রায় পাঁচ মাস হলো। এই সময়ের মধ্যে ডা. জাহাঙ্গীরকে দুইবার হাসপাতালে দেখেছি। হাসপাতালে কেন তিনি অনিয়মিত সেটা জানতে চাইলে তিনি জানান, সেটা আমার বিষয় না। বিষয়টি দেখবাল করে জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিস।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপপরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ডা. জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দুইবার লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে উল্টো জাহাঙ্গীর তাকে ফোন দিয়ে বলেন, আপনিই একমাত্র ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে কলম ধরেছে ।









Discussion about this post