নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর একাধিক স্থানে কয়েকটি বৈধ অবৈধ মদের দোকান প্রশাসন এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতাদের শেল্টারে পরিচালিত হওয়ার পরও এবার শহরের নূর মসজিদ সংলগ্ন প্যারাডাইস টাওয়ারে ব্লু পিয়ার মদের বার (আস্তানা) চালু করতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে মদ/ক্যাসিনো ব্যবসায়ী গাজী মুক্তার, লেক গ্রান্ডের ম্যানেজার আবু জাফর, কিং ফিসারের ইসমাইলসহ আরো কয়েকজন । মদের আস্তানার লাইসেন্স ফয়জুল খান ও মিনা খানের পুত্র মোঃ রাশেদ খানের নামে নেয়া হলেও মূল মালিকানায় রয়েছে নেপথ্যে অনেক রাঘববোয়ালদের নাম । এমন তথ্য অনেকের ।
প্রভাবশালী এই চক্রের হোতারা গোপনে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নারায়ণগঞ্জের গুটি কয়েক প্রভাবশালী ব্যাক্তি ও কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে গত বছর ৯ জুন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের থেকে ব্লু পিয়ার রেস্টুরেন্টের নামে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করে ১৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নানা অপকর্মের চাঁদপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সামছুল আলম অত্যান্ত গোপনীয়তার সাথে মদের লাইসেন্স প্রদান করে । এমন খবরে ফুসে উঠে নারায়ণগঞ্জের সকল শেণী পেশার মানুষ ।
খোদ নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের প্রবল বিরোধীতার পরও এবার কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বিতর্কিত ব্লু পিয়ার উদ্বোধনের সব রকম ব্যবস্থা করেছেন এর মালিক পক্ষের ধূর্ত অপরাধী চক্র । যাদের বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকায় অবৈধভাবে ক্যাসিনো / মদের আস্তানা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে ।
এমন মদের বার (আস্তানা) নিয়ে তীব্র বিরোধীতার মুখে কৌশল অবলম্বন করে ২৯ জানুয়ারি এটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে । নারায়ণগঞ্জের অসংখ্য গণমাধ্যমে বিশাল বিজ্ঞাপন আকারে ব্লু পিয়ার রেস্টুরেন্ট উদ্ভোধনের খবর দেখতে পেয়ে আবারো ফুসে উঠেছে নারায়ণগঞ্জবাসী ।
রোববার ২৬ জানুয়ারী সকাল থেকেই ভিবিন্ন পত্রিকায় এমন বিজ্ঞাপন দেখে সকলরে মুখে একই প্রশ্ন, নারায়ণগঞ্জ জেলার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ শহরে কারা এতো সাহস নিয়ে মদের আস্তানা করছে ? যে শহরে প্রভাবশালীদের কথার বাইরে কোন কিছুই ঘটতে পারে না সেই শহরে কারা এবং কার অঙ্গুলী নির্দেশনায় মসজিদের পাশে মদের আস্তানা গড়ে তুলছে ? নারায়ণগঞ্জ কি মগের মুল্লুক ? এমন নানা প্রশ্ন করছে শহরবাসী ।
জানা যায়, মদের বার নিয়ে বিরোধীতার কারণে শেষতক রেস্টুরেন্টও গুটিয়ে নারায়ণগঞ্জ ছাড়ার উপক্রম হওয়ায় ব্লু পিয়ার কর্তৃপক্ষ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। আপাত তারা বিরোধীদের চোখে ধুলু ছিটিয়ে রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করলেও মদের বার করার পরিকল্পনা থেকে পিছু হটেনি। সময় সযোগ মত পরিস্থিতি বুঝে বার উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের ।
এর আগে ব্লু পিয়ার কর্তৃপক্ষ মদের বার বিরোধীদের দমনের সূক্ষ্ম একটা চেষ্টা চালাবেন। চাইবেন নানা রকম ভাবে প্রলোভনে ফেলে পক্ষে নিয়ে আসতে অথবা নীরব করে দিতে। বিশেষ করে সাংবাদিক মহল ম্যানেজের মিশন রয়েছে সব থেকে বেশি। সে লক্ষ্যে রেস্টুরেন্ট উদ্বোধনের কথা জানিয়ে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন ব্লু পিয়ার রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ।
সূত্র বলছে, ব্লু পিয়ার কর্তৃপক্ষ কোনো রকম ভাবে রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করতে পারলে যে কোনো ভাবে হলেও এখানে মদের বার উদ্বোধন করবেনই। সে জন্য কিছুটা সময় দরকার বার বিরোধীদের ম্যানেজ করার জন্য। যদিও ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে তারা নিজেদের বগলদাবায় নিয়ে আসছেন বলে কথিত রয়েছে।
এদিকে সময় সুযোগ মত মদের বার উদ্বোধনের কথাও স্বীকার করেছেন ব্লু পিয়ার এর জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আবু জাফর। তিনি বলেন, এখন রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন হবে। পরে যদি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে তবে বার হবে। নয়তো রেস্টুরেন্টই থাকবে।
আবু জাফর ইতোপূর্বে উত্তরার লেক গার্ড নামে একটি চার তারকা হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন। বর্তমানে তিনি ব্লু পিয়ারের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) এর দায়িত্ব নিয়েছেন। তাদের সাথে রয়েছেন ইসমাইল নামে কিং ফিশার নামে ঢাকার একটি বার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। তবে, ব্লু পিয়ারে তার পদ কি বা এখানে তিনি কী করবেন, সে বিষয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি। একই সাথে প্যারাডাইজ ক্যাসেলের তিন ফ্লোর ভাড়ায় নিয়ে ব্লু পিয়ার করা চুক্তিপত্রে যার নাম রয়েছে সেই রাশেদ খানের নম্বরটিও দিতে পারেননি জিএম আবু জাফর।
তবে, ব্লু পিয়ার সংশ্লিষ্টদের অন্যতম উত্তর মতলবের জহিরাবাদ ইউনিয়নের সভাপতি গাজী মুক্তার বলছেন ভিন্ন কথা। আগের বক্তব্য থেকে তিনি সরে বলছেন, বার উদ্বোধন করবেন না। শুধু রেস্টুরেন্টই চলবে এখানে। এই জায়গাতে বার করার পরিকল্পনা থেকে তারা সরে এসেছেন।
সূত্র জানায়, প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা ভাড়ায় এবং ৪০ লাখ টাকা অগ্রিমে ১০ বছরের চুক্তিতে শহরের চাষাড়ায় প্যারাডাইজ ক্যাসেল নামক বহুতল ভবনের ৯-১১ তলা পর্যন্ত তিনটি ফ্লোর নিয়েছেন রাজধানীর সবুজ এলাকার বাসিন্দা রাশেদ খান। তিনি সম্পর্কে গাজী মুক্তারের আত্মীয়। তার নামেই হয়েছে চুক্তিপত্র। তবে, এর সমস্ত কিছু দেখভালসহ ডেকোরেশনের কাজ করিয়েছেন গাজী মুক্তার। তিনি গুলশানের বাসিন্দা এবং ক্যাসিনো কাণ্ডে ফেঁসে যাওয়া কুক্ষত সেই খালেদ সম্রাটের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে কথিত রয়েছে।
এছাড়াও রাশেদ খানের নামেই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন থেকে ব্লু পিয়ার রেস্টুরেন্টের জন্য ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছিলো। এবং দুটি মদের বারের লাইসেন্স তারা পেয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন গাজী মুক্তার। যার একটি ঢাকার উত্তরাতে চালাচ্ছেন আরেকটি নারায়ণগঞ্জে ব্লু পিয়ারে করতে যাচ্ছেন।
তিনি জানিয়েছিলেন, বিভাগীয় অনাপত্তিপত্র (এনওসি) পেয়েছেন। লাইসেন্সও পেয়েছেন। তারা বৈধ উপায়ে চাষাড়ায় মদের বার চালাবেন। এখানে লাইসেন্স ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। যাদের মদপানের লাইসেন্স রয়েছে কেবল তারাই এখানে এসে মদপান করতে পারবেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সামসুল আলম ইতোপূর্বে এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এটি (ব্ল পিয়ার) এখনওতো চালু হয়নি। আর এটি একটি রেস্টুরেন্ট। তাছাড়া আমরা কোনো এনওসি দিইনি। এ প্রসঙ্গে হেড কোয়ার্টারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন। এ বিষয়ে কথা বলার কোনো এখতিয়ার আমাদের নেই।
তবে, সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (নারকোটিকস) এর প্রধান কার্যালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছিলেন, ব্লু পিয়ার নামে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে বারের আবেদন করেনি। তবে, যদি কেউ বার স্থাপনার প্রক্রিয়া চালায় তবে, সে বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ কর্মকর্তা বলতে পারবেন এবং তিনিই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তাছাড়া সেখানে যদি কোনো বারের জন্য আবেদন কেউ করেন তবে, সেটি স্থানীয় পর্যায়ে করতে হবে।
সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির একটি মাসিক সভায় চাষাড়ায় মদের বার প্রসঙ্গে প্রথম বক্তব্য রাখেন নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম। এরপরই এ বিষয়টি আলোচনায় আসে। সংবাদ হয় গণমাধ্যমে। শুরু হয় বারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া। নাগরিক কমিটিও বার বন্ধের দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসনে আবেদন করে। হেফাজতে ইসলামও এর বিরোধীতা করে মাঠে নামে। তবে, পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে এই সংগঠনটি চুপসে যায়। সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বার বন্ধের দাবি জানিয়ে শহরে মানববন্ধন করেছে। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে আসলে এর সভাপতি বারের ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।









Discussion about this post