নারায়ণগঞ্জের ফারুক হোসেন মালবাহী নৌযানের (বাল্কহেড) সুকানি। গত ১৯ মার্চ বিকেলে বাল্কহেড চালিয়ে শীতলক্ষ্যা হয়ে মেঘনার দিকে যাচ্ছিলেন। পথে কয়লাঘাট এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু এলাকায় বড় একটি কার্গো জাহাজ আড়াআড়িভাবে এসে পড়লে তাঁর বাল্কহেডটির (এমভি পাঁচ ভাই-৩) সেতুর অস্থায়ী লোহার পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে লোহার পিলার বাঁকা হয়ে যায়।
ফারুক হোসেন বলেন, পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর সেতুর লোকজন বাল্কহেডসহ তাঁদের আটকে রাখেন এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাঁদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। পরে বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা গিয়ে দেড় লাখ টাকা দিয়ে তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন।
নৌযানের চালক ও শ্রমিকেরা বলছেন, শীতলক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জের ওই অংশ বহু বছর ধরেই দেশের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক নৌপথ। তবে দখলে-দূষণে দিন দিন সরু খালে পরিণত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা। আর এই নদীপথে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল ও নদীতে নোঙর করে রাখা নৌযানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় শীতলক্ষ্যায় নৌযান, বিশেষ করে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের জরিপ অনুযায়ী ১৯৬০ সালে শীতলক্ষ্যার মোহনায় নদী ৭৮০ মিটার প্রশস্ত ছিল। ২০২০ সালে সেই নদীর মোহনার প্রশস্ততা ৩৬৫ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক সামসুন নাহার বলেন, ১৯৬০ সালে প্রথম ও ২০২০ সালে সর্বশেষ শীতলক্ষ্যা জরিপ করে হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ। সে অনুযায়ী গত ৬০ বছরে শীতলক্ষ্যার ডেমরা অংশে ১০৬ মিটার, নবীগঞ্জ ফেরিঘাট অংশে ১৫৩ মিটার, বন্দর ফেরিঘাট অংশে ১৩৭ মিটার ও শীতলক্ষ্যার মোহনা শাহ সিমেন্ট পয়েন্টে ৪১৫ মিটার প্রশস্ততা কমেছে।
আর জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরে প্রায় দুই হাজার দখলদার শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীর দখল করে স্থাপনা গড়ে তুলেছে। তবে শীতলক্ষ্যা নদী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় বলছে, নদীর দুই তীরে প্রকৃত দখলদারের সংখ্যা নদীরক্ষা কমিশনের দেয়া হিসাবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) মাসুদ কামাল বলেন, কেবল নারায়ণগঞ্জ অংশেই নদীটির তীরে দুই হাজারের বেশি দখলদার শীতলক্ষ্যা দখল করে আছে।
দখল-দূষণে সরু হয়ে শীতলক্ষ্যার ওপর চলছে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণের কাজ। সেতু নির্মাণকাজের জন্য নদীর দুই পাশের অনেকটা জায়গা লোহার পিলার দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, যার কারণে বাড়ছে নৌযানের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাক্কার ঘটনা। শীতলক্ষ্যা নদীতে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ বড় দুটি লঞ্চডুবির ঘটনাও ঘটেছে অন্য নৌযানের ধাক্কায়। এতে অন্তত ১০ জন নিখোঁজ যাত্রী ছাড়াও ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, যার একটি ঘটেছে ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় কয়লাঘাট এলাকায় নির্মাণাধীন সেতু এলাকায়। সেদিন এক সাংসদের মালিকানাধীন কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ‘সাবিত আল হাসান’ নামে একটি লঞ্চ ডুবে ৭ শিশুসহ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। ওই প্রাণহানির পর শীতলক্ষ্যার সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
বাংলাদেশ জাহাজী শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদার বলেন, শীতলক্ষ্যা নদীর অধিকাংশজুড়ে লোহার পিলার দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় নৌপথ একেবারে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। গত এক বছরে সেতুর ওই অংশে অন্তত ৫০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই সব দুর্ঘটনায় কেউ হতাহত না হওয়ায় হইচই হয়নি। তবে এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নৌযান পরিচালনাকারীরা। সেতুর ওই অংশ সম্প্রসারণের জন্য জেলা প্রশাসক, নৌ পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএকে স্মারকলিপি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
* নদীরক্ষা কমিশনের হিসাবে শীতলক্ষ্যায় প্রায় ২ হাজার দখলদার। * বিআইডব্লিউটিএর হিসাবে দখলদারদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। * নদীর বুকে সিগন্যাল ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চান জাহাজমালিকেরা।
বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ অফিসের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক (নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) বাবু লাল বৈদ্যও বলেন, সেতু নির্মাণকাজের জন্য বড় দুটি কার্গো নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে পারছে না। জরুরি ভিত্তিতে সেতুর লোহার স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণকাজের প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ বলেন, সেতু নির্মাণকাজের জন্য অস্থায়ীভাবে লোহার তৈরি সেতু (ট্রেসেল) নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর যে অংশটুকু খোলা রাখা হয়েছে, সেটি দিয়ে বড় দুটি কার্গো জাহাজ চলাচল করতে পারে। দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমস্যা তো একটু হবেই। সতর্কতার সঙ্গে নিয়ম মেনে নৌযান চলাচল করলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সেতু এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সিগন্যাল বাতি ও লোক নিযুক্ত রয়েছে।
সেতু এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এ রকম এক প্রহরী মো. হালিম। তিনি বলেন, তাঁরা সেতুর ওপর থেকে গতি কমিয়ে চালানোর জন্য নৌযানগুলোকে সংকেত দেন। তবে নৌযানগুলোর চালকেরা সেই সংকেত গ্রাহ্য করেন না। ফলে সংকীর্ণ নৌপথে দ্রুত চালিয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে সম্প্রতি কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।
গত রোববার গিয়ে দেখা যায়, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণকাজের লোহার অবকাঠামোগুলো নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষের চিহ্ন বহন করছে। নদীর পূর্ব পাড়ে সেতুর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত মোটা লোহার পিলারের অনেকগুলো বাঁকা হয়ে গেছে। একরামপুর, মদনগঞ্জসহ নদীর বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি নোঙর করে রাখা হয়েছে সিমেন্ট কারখানার কাঁচামালবাহী কার্গো জাহাজসহ বিভিন্ন নৌযান। নদী সরু হয়ে যাওয়ায় বালুবাহী বাল্কহেডগুলো সারিবদ্ধভাবে ৮ থেকে ১০টি একত্রে চলাচল করছে। মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানের বালুমহাল থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে তোলা বালু এসব বাল্কহেডে করে রূপগঞ্জের পূর্বাচলসহ বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প এলাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব কার্গোসহ নৌযান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নির্মাণের ওই জায়গায় (শহরের কয়লাঘাট) এসে ধীরগতিতে চলছে। ওই জায়গায় দুটি কার্গো জাহাজ পাশাপাশি একসঙ্গে চলতে পারছে না। একদিক থেকে একটি কার্গো জাহাজ পার হওয়ার জন্য অন্যটিকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ কার্গো জাহাজ ভেসেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক বলেন, নির্মাণাধীন সেতুর কারণে নদীর ওই অংশে প্রায়ই লোহার পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগছে এবং দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে নৌযানগুলো। এখানে সিগন্যাল ও নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করা জরুরি ।
আর নদীতে জাহাজ নোঙর করে রাখার বিষয়েও কড়াকড়ি আরোপের কথা বললেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার (যাত্রী পরিবহন) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বদিউজ্জামান। তিনি বলেন, সেতুর ওখানে নদী এখন ২৫ শতাংশও অবশিষ্ট নেই। সেখানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। আর সেতুর উত্তর ও দক্ষিণে সিমেন্ট কারখানার জাহাজগুলো নোঙর করে রাখার কারণে ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
সূত্র : প্রথম আলো









Discussion about this post