নিম্নে উল্লেখিত এমন অসংখ্য ঘটনা নারায়ণগঞ্জের প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে, প্রতিটি ক্লিনিকে, ডায়াগণস্টিক সেন্টারে য়ুগ যুগ ঘটলেও এ যাবৎকালে আইনশৃংখলা বাহিনীর কোন সংস্থা কোনভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। এ যেন, ”এলোমেলো করে দে মা, চেটেপুটে খাই !”
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার মুক্তারপুর গ্রামের মো. সাকিব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন গত বছরের ৪ অক্টোবর। স্থানীয় একটি অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে আনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় জরুরি বিভাগের চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য সাকিবকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
এরপর সেখান থেকে বের করে সাকিবকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় কয়েকজন এসে বাধা দেন। হাসপাতাল চত্বরে অবস্থানকারী এই অ্যাম্বুলেন্সচালক ও সহকারীদের দাবি, তাঁদের অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া রোগী নেওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর সাকিবের পরিবার বাধ্য হয়ে তাঁদের একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে রওনা হন। মাঝপথে চালক-সহকারীর কথার ফাঁদে পড়ে তাঁরা যান শিন শিন জাপান নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে গুরুতর রোগীর চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাঁরা আবার ঢাকা মেডিকেলে যান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সাকিব।
সাকিবের স্বজনদের মতো এ রকম ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকেই। গত ছয় মাসে এ রকম বেশ কয়েকজন রোগী ও স্বজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, যাঁরা অ্যাম্বুলেন্সচালক ও সহকারীর কথার ফাঁদে পড়ে উত্তরার হাসপাতালে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করছেন। চালক ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এভাবে বেশি রোগী নেওয়া হয় উত্তরার শিন শিন জাপান, লেকভিউ, আরএমসি ও আল-আশরাফ জেনারেল হাসপাতালে। একসময় রিজেন্ট হাসপাতালেও এভাবে রোগী নেওয়া হতো। করোনা পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এসব হাসপাতালে রোগী নিতে পারলেই মোট বিলের ৩০ শতাংশ কমিশন পান চালকেরা। আর চালকদের এককালীন টাকা দিয়ে রোগী ভর্তি করানোকে বলা হয় ‘রোগী বেচাকেনা’।
সাকিবকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু মো. সোহাগ। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, অ্যাম্বুলেন্সটি তখন টঙ্গী বা তার কাছাকাছি। এ সময় চালকের পাশে থাকা এক ব্যক্তি রোগীর অবস্থা ভালো না, ঢাকা যেতে দেরি হতে পারে জানিয়ে আশপাশের কোনো হাসপাতালে নিলে ভালো হবে বলে পরামর্শ দেন। এই প্রস্তাবে তাঁরা প্রথমে রাজি হননি। পরে চালকও কয়েকবার এসব কথা বলে তাঁদের ভয় দেখাতে থাকেন। পরে রোগীর অবস্থা চিন্তা করে তাঁরা রাজি হয়ে যান। এরপর তারা শিন শিন জাপান হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সোহাগ বলেন, ‘হাসপাতালটিতে যাওয়ার পরই বুঝতে পারছিলাম, আমরা দালালের পাল্লায় পড়েছি। কথা আর কাজের মিল পাচ্ছিলাম না। পরে আমরা রাগারাগি শুরু করলে ওই চালকই আবার আমাদের ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যান। এরপর সাকিব চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। মাঝখানে নষ্ট হয় গুরুত্বপূর্ণ সময়।’
এ বিষয়ে খোঁজ নিতে সম্প্রতি শিন শিন জাপান হাসপাতালের অভ্যর্থনায় গিয়ে জানতে চাওয়া হয়, নিয়মিত রোগী দিতে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ সময় আল আমিন নামের একজনের মুঠোফোন নম্বর দেন তিনি। ১ এপ্রিল দেখা হয় আল আমিনের সঙ্গে। এ সময় আল আমিন জানান, তিনি হাসপাতালটির ‘বিজনেস ডেভেলপমেন্ট এক্সিকিউটিভ’। তিনিসহ সাতজন এক্সিকিউটিভ কাজ করেন হাসপাতালটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (অপারেশনাল ম্যানেজমেন্ট) জাহিদুল ইসলামের অধীনে। কোনো রোগী দিতে পারলে মোট চিকিৎসা খরচের ৩০ শতাংশ টাকা কমিশন দেবেন বলে জানান। তিনি হাসপাতালের নামে কমিশন দেওয়ার একটি রসিদও বের করে দেখান।
এরপর সাংবাদিক পরিচয়ে ১২ এপ্রিল দুপুরে যোগাযোগ করা হয় শিন শিন জাপান হাসপাতালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। এ সময় কমিশনের বিষয়টি তুললে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে এ ধরনের কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। যে বলেছে মিথ্যা বলেছে।’
উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের গরীব-ই-নেওয়াজ সড়কে অবস্থিত শিন শিন জাপান হাসপাতাল, একই সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কে লেকভিউ, ৭ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কে আরএমসি এবং ১২ নম্বর সেক্টরের খালপাড় এলাকায় অবস্থিত আল-আশরাফ জেনারেল হাসপাতাল। প্রতিটি হাসপাতালই গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবনে। আল-আশরাফ, লেকভিউ এবং আরএমসি হাসপাতালে গিয়েও অনেক রোগী পাওয়া যাওয়া যায়, যাঁদের সেখানে ভুল বুঝিয়ে আনা হয়েছে বলে জানান। আল-আশরাফ জেনারেল হাসপাতালে মো. আলতাফ নামের একজন তাঁর মা হাফেজা বেগম এবং লেকভিউ হাসপাতালে মো. মিজানুর রহমান তাঁর ভাই মো. শাজাহানকে নিয়ে এসে প্রতারিত হওয়ার কথা জানান।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আল-আশরাফ জেনারেল হাসপাতালের মালিক পর্যায়ের একজন মো. শামীমের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। রোগী দিতে চাওয়া হলে তিনি সরাসরি দেখা করতে চান। পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে টঙ্গীতে দেখা হয় শামীমের সঙ্গে। এ সময় তাঁর সঙ্গে আসেন হাসপাতালটির পরিচালক (অর্থ) ইউসুফ মামুন চৌধুরী। কমিশনের বিষয়ে তাঁরা বলেন, অনেক হাসপাতাল রোগী কিনে নেয়। কিন্তু তাঁরা সেটা করেন না। তাঁরা ৩০ শতাংশ কমিশন দেবেন।
এরপর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ১২ এপ্রিল ইউসুফ মামুনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ ধরনের কোনো কথা বলিনি। আমরা কোনো কমিশন দিই না।’
গত ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় দেখা হয় আরএমসি হাসপাতালের পরিচালক (করপোরেট) রফিকুল ইসলামের (সালাম) সঙ্গে। কমিশনের বিষয়ে কথা তুলতেই তিনি নিয়ে যান হাসপাতালের নিচতলায় থাকা তাঁর অফিস কক্ষে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আপনি আমাদের এখানে চাকরি করতে পারেন। রোগী প্রতি আপনি ৫ শতাংশ হারে বেতন পাবেন, আর ২৫ শতাংশ পাবেন কমিশন। এ কাজ করলে আর পেছনে তাকাতে হবে না।’
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ১২ এপ্রিল রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরেন তাঁর ভাই মো. জহির রায়হান। রফিকুল অসুস্থ থাকায় তিনি দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানান। কমিশনের বিষয়ে জানতে চাইলে জহির বলেন, তাঁরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগী নেন না, তবে হাসপাতালের মার্কেটিংয়ের লোক আছে। তাঁদের মাধ্যমে কোনো রোগী এলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন দেওয়া হয়।
লেকভিউ হাসপাতালের অভ্যর্থনাকক্ষে থাকা মো. রিফাত নামের একজনের সঙ্গে কথা হয় গত ৩১ মার্চ। অ্যাম্বুলেন্সে রোগী দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীকালে বিষয়টি জানানোর কথা বলেন। এরপর মুঠোফোনে কল করে তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাকে চিকিৎসা শেষে ৩০ ভাগ টাকা কমিশন দেব।’ পরে সাংবাদিক পরিচয়ে হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক মো. মোস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। রিফাত তাঁদের হাসপাতালের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআরও) বলে তিনি জানান। একপর্যায়ে রোগীর জন্য কমিশনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কমিশন দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা-বানোয়াট। রিফাত কী বলেছে, সেটা আমি জানি না।’
রাজধানীর এই চারটি হাসপাতালই পড়েছে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায়। ৯ এপ্রিল ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মো. আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, দালালের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে আনা, কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়া, বিল বেশি বা রোগী আটকে রাখার অভিযোগ মাঝেমধ্যে তাঁদের কাছেও আসে। তাঁরা ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেন। এর মাঝে সপ্তাহ দুয়েক আগেও তিনি নিজে এ রকম দুটি ঘটনার সমাধান করেছেন বলে জানান।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম বলেন, এটা সাংঘাতিক অন্যায় । (তার ভাবভঙ্গি এমন করেছেন যে তিনি এমন অপরাধের কথা এই প্রথম শুনতে পাচ্ছেন ) যদি কোনো কারণে ফাঁদ তৈরি করে বা কোনোভাবে রোগীকে ভাগিয়ে অন্য কোথাও নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় সেসব হাসপাতাল বা অ্যাম্বুলেন্সের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই।
এমন অসংখ্য ঘটনার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জে সকল সরকারী হাসপাতাল, বেসরকারী ক্লিনিক -ডায়াগণস্টিক সেন্টার, অনেক এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারদের এমন অপরাদের বিষয়গুলি খুব ভালোভাবে জানা থাকলেও প্রায় সকল কর্মকর্তা কর্মচারীরা যেন একে অপরের পরিপূরক । সকলেই সকলের অপকর্ম/অপরাধের সকল ফিরিস্তি জানা থাকলেও কেউ কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন নাই । এ যেন, ”এলোমেলো করে দে মা, চেটেপুটে খাই !”









Discussion about this post