অনলাইন ডেস্ক :
গুরুজনেরা বলেন, অপরের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেই পড়ে। কথাটা আরও একবার প্রমাণিত হলো। নিউইয়র্কের পেশাদার জালিয়াত ও কথিত সাংবাদিক দর্পণ কবীর ও তার স্ত্রী সীমা সুস্মিতা গোপন মিশন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নিজেরাই ধরা খেলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ত্রীর আবেদনপূর্ণ ছবি পোস্ট করে প্রবাসে ব্যবসায়ী ও ধণাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে পরবর্তীতে নানা কায়দায় জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা-সম্পত্তি হাতিয়ে নিত এই দম্পতি। তাদের হাতে প্র’তারিত হন বেসরকারি বাংলা টেলিভিশন একাত্তর টিভির নিউইয়র্ক সংবাদদাতা মাহফুজুর রহমান।
তার কাছ থেকে এই দম্পতি হাতিয়ে নেয় নগদ ৩৩ হাজার ডলার। যা মাহফুজুর রহমান করোনার সময় সরকারের কাছ থেকে ঋ’ণ হিসাবে পেয়েছিলেন। মাহফুজুর রহমানের অভিযোগের ভিত্তিতে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এমন আরো ঘটনা। সাইবার ক্রাইম ইউনিটে দায়ের করা অভিযোগে সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান বলেছেন, দর্পণ কবীরের স্ত্রী সীমা সুস্মিতা তাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
পরে নানা বিষয়ে তাদের চ্যাট হয়। একপর্যায়ে সে তার কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে। এ বিষয়ে কথাবার্তা বলার একপর্যায়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। যা দিয়ে মাহফুজুরকে ট্র্যাপে ফেলে সুস্মিতা। তাদের মধ্যকার চ্যাটিং আলাপের স্ক্রিণশট প্রকাশ করে দেয়ার হুম’কি দেয়। মাহফুজুর রহমান এসব নিয়ে বাইরে কথা না বলার অনুরোধ জানালে তার কাছে অর্থ দাবি করা হয়।
নিরুপায় হয়ে কুইন্স বুলেভার্ডের একটি মোটেলে দেখা করে সম্প্রতি পাওয়া ৩৩ হাজার ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৫ লাখ টাকা) সীমা সুস্মিতার হাতে তুলে দেন তিনি। এই অর্থ পাওয়ার পরেও মাহফুজুর রহমানের কিছু ভিডিও প্রকাশ করে দেয় এই দম্পতি। সাইবার ক্রাইম ইউনিট এ ঘটনার তদন্ত গিয়ে আরো কিছু গুরুতর তথ্য পেয়েছে।
সূত্র জানায়, দর্পণ কবীর লুকানো ক্যামেরার মাধ্যমে নিজের স্ত্রীকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে ‘অতি ঘনিষ্ঠ’ ভিডিও ধারণ করে। পরে সেসব ব্যবহার করে তাদেরকে ট্র্যাপে ফেলা হয়। এ সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ক্লিপ সাইবার ক্রাইম ইউনিটের হাতে এসেছে।

দর্পণ কবীরের পাসপোর্ট (ব্যক্তিগত তথ্যগুলো আড়াল করে দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০১ সালে ভ্রমণ ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয় দর্পণ কবীর ও সীমা সুস্মিতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অন্যতম মদদদাতা রাজনৈতিত সংগঠন ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার ছিল দর্পণ। যুক্তরাষ্ট্রে এই পরিচয়েই সে রাজনৈতিক আশ্রয় পায়। পরে তারা মার্কিন নাগরিকত্ব পায়। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল হলেও প্রকৃত তথ্য গোপন করে পুনরায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়ন করছে বছরের পর বছর ধরে। এর পেছনে কারণ হলো বাংলাদেশ থেকে আদম ব্যবসা করা। ৩-৪ বছর আগে দর্পণ পুরান ঢাকায় আব্দুল খালেক নামে এক ব্যক্তিকে নিজের শ্বশুর বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড করে দেয়। অথচ তার শ্বশুরের নাম মৃ’ত হাবিবুর রহমান। বাংলাদেশে আব্দুল খালেকের স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনিও রয়েছে। পুরান ঢাকার এই ব্যবসায়ীকে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ড পাইয়ে দেবার বিনিময়ে ওয়ারি এলাকায় অর্ধকোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট আদায় করে নেয় দর্পণ কবীর। এ ঘটনারও তদন্ত চলছে।
নিউইয়র্কে দর্পণ কবীরের মূল পেশা জালিয়াতি। তার স্ত্রী সীমা সুস্মিতা একটি হাসপাতালের আয়া। মাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা এই নারী বাংলাদেশে থেকে এসএসসি, এইচএসসি ও ডিগ্রি পাশের জালসনদ এনে হাসপাতালের কর্মকর্তা পদে চাকরির আবেদন করে। কিন্তু সনদ যাচাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে সেগুলো আসল নয়। আয়া পদে চাকরি করলেও নিজেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স পরিচয় দেয় সীমা সুস্মিতা। এদিকে ৪-৫ বছর আগে দর্পণ কবীর নিউইয়র্কে পাকিস্থানি মালিকানাধীন একটি মিডিয়া হাউজে চাকরি করলেও এক নারী কর্মীর সঙ্গে অ’প্রীতিকর অবস্থায় ধরা পড়ায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর থেকে স্ত্রীর কর্মস্থল কুইন্স হাসপাতালে রোগী পরিবহনের কাজ করে দর্পণ কবীর। মূলত, পেশাগত এই পরিচয় হলো তাদের কাভার। এর আড়ালে মূল পেশা জালিয়াতি। ফেসবুকে স্ত্রীর একক বা দ্বৈত ছবি দিয়ে ধণাঢ্য ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে অর্থকড়ি লোপাট করাই মূল ব্যবসা। কিন্তু সর্বশেষ ঘটনাটি প্রকাশ পাওয়ায় তারা এখন গা ঢাকা দিয়েছে।

বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঘুরছে সুস্মিতার ব্যক্তিগত ভিডিও চিত্র।
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার বাইরে থাকলেও একটি অনলাইন পত্রিকার নামে এবং স্ত্রী ও মেয়ের নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সর্বশেষ ৯৪ হাজার ৩০০ ডলার করোনাকালীন ঋ’ণ নেয় দর্পণ কবীর। নিউইয়র্ক যুবদলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার প্রতিষ্ঠান থেকে জাল কাগজপত্র জমা দিয়ে এই অর্থ তুলে লোপাটের অভিযোগ পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ।
জালিয়াতির দায়ে এর আগে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে দর্পণ কবীর। জেলও খেটেছে। কিন্তু এই সাজা উপযুক্ত না হওয়ায় দিন দিন অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলেছে এই দম্পতির। সর্বশেষ ঘটনার আগে দর্পণ কবীর দম্পতি নিউইয়র্কের খ্যাতনামা চিকিৎসক ডা. ফেরদৌস খন্দকারের জন্যও একটি বড় জাল পেতেছিল। স্ত্রী সুস্মিতাকে ব্যবহার করা হয় একইভাবে। কিন্তু সতর্ক থাকায় সে যাত্রায় রক্ষা পান ওই স্বনামধন্য চিকিৎসক।
ডা. ফেরদৌস খন্দকারের ঘটনার পূর্বে নির্মল পালক নামে আরেক প্রবাসীর কাছ থেকে একই উপায়ে অর্থ হাতিয়ে নেয় দর্পণ কবীর ও সীমা সুস্মিতা। ঘটনা জানাজানি হলে নির্মল পালকের জ্যামাইকার মালিকানাধীন মেডিকেল অফিস থেকে আয়ার চাকরি হারায় সীমা সুস্মিতা। বাংলাদেশি কমিউনিটির একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, দর্পণ কবীর ও তার স্ত্রী সীমা সুস্মিতার জালিয়াতির জাল খুবই বিস্তৃত। তাদের কর্মকাণ্ড পুরো কমিউনিটিকে লজ্জায় ফেলেছে। এর আগে বাংলাদেশে গিয়ে নারায়ণগঞ্জে একটি আলোচিত মামলায় জেল খেটেছে দর্পণ কবীর। ওই মামলায় তার আপন ভাগ্নেও আসামী ছিল।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলেন, দর্পণ কবীর অতি ধূর্তপ্রকৃতির লোক। কখনো সে ট্যাক্সিচালক, কখনো সাংবাদিক সাজে। কখনো কবি, আবার সাহিত্যিকের বেশ ধরে। অথচ সে মাধ্যমিকও পাস করতে পারেনি। কেউ তার অপ’কর্মের প্রতিবাদ করলে একটি অখ্যাত অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে তার নামে কল্পকাহিনী প্রচার করে। ওই পত্রিকাকে সে হা’তিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে।
জালিয়াতি, আদম পাচারসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হলে দর্পণ কবীরের দীর্ঘমেয়াদে সাজা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
সূত্র: ইউএস-বাংলা নিউজ, নিউইয়র্ক।









Discussion about this post