১৯১১ সালের ভারতবর্ষ। কলকাতাসহ নানা জায়গায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে প্লেগ। চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে অগণিত মানুষ। অসহায় মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে প্লেগের হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ভগিনী নিবেদিতা। হঠাৎ ১৩৯ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিট থেকে একটি চিঠি এল। এই ঠিকানায় ববিবাবুর পরিচিত কেউ থাকে না। তবে চিঠি খুলে তিনি দেখলেন, সেটি লিখেছেন অকৃত্রিম সুহৃদ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। চিঠিতে তিনি লিখেছেন: ‘উপরের ঠিকানা হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি পলাতক প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটি লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল। সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়। আর ৩০ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু। বাড়ি ছাড়িয়া উক্ত ঠিকানায় আছি। কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না।’
জীবদ্দশায় ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, প্লেগের মতো প্রাণঘাতী বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সাহিত্যকর্মে এসব মহামারির জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।
গত শতাব্দীর প্রারম্ভে গুটিবসন্তে ভারতবর্ষে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। এই মহামারিতে প্রাণ হারায় অগণিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার’ কবিতায় রাজনর্তকী বাসবদত্তা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। কবির ভাষায়, ‘নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ/রোগমসী-ঢালা কালি তনু তার/লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার/বাহিরে ফেলেছে করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।’ সন্ন্যাসী উপগুপ্ত এই দুঃসময়ে সেবা করে বাসবদত্তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় পুরাতন ভৃত্য কেষ্টার মৃত্যুও হয়েছিল গুটিবসন্তে আক্রান্ত মনিবকে মনপ্রাণ দিয়ে সেবাযত্নের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলার পর। চতুরঙ্গ উপন্যাসের জ্যাঠামশাই প্রতিবেশীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘নাস্তিক’ হিসেবে। যখন প্লেগের আক্রমণে সবাই দিশেহারা হয়ে নিরাপদ স্থানে পালাচ্ছে, তখন তিনি দায়িত্ব নিলেন অসহায় চামারদের নিরাপত্তা বিধানের। নিজের বাড়িতে প্লেগ রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল স্থাপন করলেন। মুসলমান ও গরিব রোগীদের সেবা করতে করতে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায় অবনীন্দ্রনাথের শিশুকন্যা। অসংখ্য পরিবারে তখন মৃত্যুর আওয়াজ। হননের কালে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘…ম্যালেরিয়া-প্লেগ-দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষমাত্র, তাহারা বাহ্য লক্ষণমাত্র—মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। আমরা এতদিন একভাবে চলিয়া আসিতেছিলাম আমাদের হাটে বাটে গ্রামে পল্লীতে আমরা একভাবে বাঁচিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম, আমাদের সে ব্যবস্থা বহুকালের পুরাতন। তাহার পরে বাহিরের সংঘাতে আমাদের অবস্থান্তর ঘটিয়াছে। এই নতুন অবস্থার সহিত এখনো আমরা সম্পূর্ণ আপস করিয়া লইতে পারি নাই; এক জায়গায় মিলাইয়া লইতে গিয়া আর এক জায়গায় অঘটন ঘটিতেছে। যদি এই নতুনের সহিত আমরা কোনোদিন সামঞ্জস্য করিয়া লইতে না পারি তবে আমাদিগকে মরিতেই হইবে।’
করোনা বিপর্যয় আমাদের সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। মানুষ সামাজিক জীব। সংঘবদ্ধতাই মানুষের ধর্ম। অথচ সামাজিক দূরত্ব তথা বিচ্ছিন্নতাই এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, সর্বোপরি ধরণির স্বার্থে এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের সামঞ্জস্যবিধান করতেই হবে। ‘যদি এই নতুনের সহিত আমরা কোনোদিন সামঞ্জস্য করিয়া লইতে না পারি তবে আমাদিগকে মরিতেই হইবে’—রবীন্দ্রনাথের এই সাবধানবাণী কাকতালীয়ভাবে বর্তমান মহামারির সময়ে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
মেয়ে মীরার বিয়ে নিয়ে সারা জীবন অবসাদে ভুগেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর !
রবি ঠাকুর ভয় পেতেন মৃত্যুকে।
অকালপ্রয়াণকে।
একবার মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করিনি। ভয় করি অপঘাত মৃত্যুকে।” সেই মানুষটাই চেয়েছিলেন নিজের মেয়ের অপঘাতে মৃত্যু। কারণ মেয়ের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির মনে প্রাণে এই একটাই নাম। সাহিত্য মানেই তো কবিগুরু। কবিতা মানেই তো কবিগুরু। তাঁকে বাদ দিয়ে আমাদের জীবনে বোধহয় একটা মুহূর্তও নেই। তিনি তাঁর কলমে লিখে গিয়েছেন সর্বকালের কথা। ওই সময়ে বসে তিনি বলে গিয়েছেন আজকের কথা। রবি ঠাকুর যেন কখনও অপ্রাসঙ্গিক নন। সব সময় তিনি নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করেন। কিন্তু এই মানুষটা যিনি বলে গিয়েছেন হাজার মানুষের মনের সবচেয়ে কাছের কথাগুলি, তিনিও কিন্তু ভুগতেন মনকষ্টে। যন্ত্রণা তাঁকে সব সময় দহন করত। আর সেই কারণেই রবি ঠাকুর সবার মধ্যে থেকেও ছিলেন খুবই একা।
আর তাই হয়তো তাঁর কলমে উঠে এসেছিল, ‘ প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন’-এর মতো লেখা। কোথাও তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করত কোনও অজানা বেদনা। তা কবি বুঝতে পারতেন মন থেকে। তাই অমলের একাকিত্ব আজও আমাদের কাঁদায়।
রবি ঠাকুর ভয় পেতেন মৃত্যুকে। অকালপ্রয়াণকে। একবার মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করিনি। ভয় করি অপঘাত মৃত্যুকে।” সেই মানুষটাই চেয়েছিলেন নিজের মেয়ের অপঘাতে মৃত্যু। কারণ মেয়ের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। চেয়েছিলেন মেয়ে তাঁর জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাক।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট মেয়ে মীরার বিয়ে দিয়েছিলেন নিজের পছন্দের পাত্র নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে। কিন্তু এই বিয়েতে সম্মতি ছিল না মীরার। তবে সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় এই বিয়ে দিয়েছিলেন রবি ঠাকুর। তবে তাঁর আশা পূর্ন্য হয়নি। নগেন ছিলেন স্বেচ্ছাচারী। বর্ব্বরতা ছিল নগেনের মজ্জায় মজ্জায়। এ কথা জানতেন না রবীন্দ্রনাথ । আর এই স্বামীকে কোনও দিনও ভালবাসতে পারেননি মীরা। বাবা হিসেবে মেয়ের এই জীবন দেখে অপরাধে ভুগতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ভেবে গিয়েছেন তাঁর চাপিয়ে দেওয়া বিয়ের জন্যই তাঁর মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে। আর এই উপলব্ধি থেকেই তিনি লিখেছেন,”বিয়ের রাত্রে মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকছিল তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফনা ধরে উঠেছিল— আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনই ওকে কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।” মেয়ের মৃত্যু কামনাও করে ফেলেছিলেন তিনি। তবে ওপর থেকে দেখলে মনে হয় তিনি মীরার মৃত্যু চাইছেন। আসলে তিনি চাইতেন মীরা মুক্তি পাক তাঁর জীবন থেকে। বাবা হয়ে এই ভাবনাও যে কতটা কষ্টের তা শুধু তিনিই জানতেন। রবি ঠাকুরের জীবন তাই মোটেই ছিল না বিলাসবহুল। প্রতি মুহূর্তে তাঁর মনে এসে দানা বাঁধত বেদনা, যন্ত্রণা।
মৃত্যু, চিকিৎসা এবং শত বছর পর পর এমন মহামারী নিয়ে রবি ঠাকুর তার রচনা- প্রবন্ধ ও কবিতা গাণে লিখে গেছেন নানা বাণী । যা এই করোনা কালেও জাগ্রত ।









Discussion about this post