চার লেনের বর্তমান ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। তবে বহুল কাঙ্খিত এই সড়কটির উন্নয়ন কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সড়কটি প্রশস্তকরণের কাজে যেমন ভরাট বালুর বদলে লাল মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে তেমনি নিম্নমানের ইট ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগে জানা গেছে।
এছাড়া সড়কটির ৬ লেনে উন্নীতকরণের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ৮ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র দেড় থেকে দুই কিলোমিটার অংশে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ হয়েছে। ফলে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য ৮.১৫ কিলোমিটার। এটি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (লিংক রোড) নামেও পরিচিত। সড়কটি নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। তবে ৫০ ফুট চওড়া সড়কটির বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পনার অভাবে যানজট লেগেই থাকতো।
গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটির প্রস্থ খুবই ক্ষীণ। সড়কটি যে আয়তনের তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে এ সড়কে। এসব কারণে জনগুরুত্বপূর্ণ লিংক রোডটি যথাযথ মানে উন্নীত করার জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে ডিপিপি প্রণয়ন করে প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
প্রকল্পটির প্রস্তাব পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ৮ জুলাই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দেয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পুনর্গঠন করা হয়। পরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হলে সেটির অনুমোদন দেয়া হয়।
২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর সড়কটি ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্যাকেজ কাজের ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন পায়। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের অনুপস্থিতিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ৩৫তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়ক (আর-১১১) ছয় লেনে উন্নীতকরণে অনুমোদিত প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩৬৪ কোটি ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৭ টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই), তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড এবং হাসান টেকনো ব্রাদার্স লিমিটেড। এখানে লিড পার্টনার হিসেবে থাকছে তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড।
২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৮ কিলোমিটার ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সড়কটি ছয় লেনে উন্নীতকরণের কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত হলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ যাতায়াতে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। এছাড়াও এ সড়ক দিয়ে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া থেকে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর-লৌহজং-মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচে যাতায়াত করা যাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই গেল অর্থবছরে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ চলছে।
সড়ক ও জনপথ নারায়ণগঞ্জ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ৬ লেনে উন্নীত করার পর সড়কটির মোট প্রশস্থতা হবে ১৩৮ থেকে ১৪০ ফুট। শিবু মার্কেট, জালকুড়ি ও ভুইগড় নামক স্থানে একটি করে আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। যাত্রী ওঠা-নামার জন্য যানবাহন যেন থামতে পারে সেজন্য বাস-বে নির্মাণ করা হবে। জনগণের পারাপারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান সাইনবোর্ড ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এছাড়া মাতুয়াইল ও সানারপাড় এলাকায় ইউটার্ন থাকবে।
আগে যেভাবে নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট অভিমুখী গাড়ি সাইনবোর্ড দিয়ে যেত তাদেরকে তখন মাতুয়াইল ঘুরে যেতে হবে। তেমনি ঢাকা কিংবা অন্য জেলা থেকে আগত গাড়িগুলোকে সানারপাড় হয়ে আসতে হবে। এতে করে সাইনবোর্ড মোড়ে কোন যানজট থাকবেনা। যেমনটি করা হয়েছে বনানী তেজগাও এলাকায়। সড়কটির মাঝখানে দুই মিটার চওড়া মিডিয়ান থাকবে। এর মধ্যে নানা প্রজাতির ফুল ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ থাকবে। পুরো সড়কে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। ধীরগতির যানবাহনের জন্য সাড়ে পাঁচ মিটার চওড়া করে উভয়পার্শ্বে সার্ভিস লেন থাকবে। সড়ক বিভাজক দিয়ে তা আলাদা করা হবে। সড়কের পাশ দিয়ে মানুষের পায়ে হেটে চলাচলের জন্য ফুটপাথ থাকবে। সেখানে বাগান হবে।
সড়কে যেন পানি না জমে তার জন্য আরসিসি ইউ ড্রেন, সসার ড্রেন নির্মাণ করা হবে। যানবাহন সুশৃঙ্খলভাবে সড়ক পার হওয়ার জন্য একটি ইউটার্ন থাকবে।
চার লেনের বর্তমান সড়কের পুরাতন পেভমেন্ট তুলে সেটি আবার নতুন করে নির্মাণ করা হবে। ৯টি বক্স কালভার্ট স¤প্রসারণ করা হবে। এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় একটি মসজিদ ও একটি অফিস ভবন নির্মাণ করা হবে। সড়কটি প্রশস্থ করার কাজ শেষ হলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক যোগাযোগে কোন যানজট থাকবে না। ফলে কম সময়ে আসা-যাওয়া করা যাবে। এতে আর্থিক সাশ্রয়ও হবে।
এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী থেকে সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হলেও এর উন্নয়ন কাজ চলছে ঢিমেতালে। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ শেষে হতে আরো ৯ মাস বাকী থাকলেও এখনো ২৫ ভাগ কাজও শেষ হয়নি। ৮ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে মাত্র দেড় থেকে দুই কিলোমিটার ব্যাপী সড়ক প্রশস্তকরণের জন্য সড়কের দুই পাশে ভরাট বালু ফেলা হয়েছে। তবে এর মধ্যে বেশ কিছু স্থানে ভরাট বালুর বদলে লাল রঙের মাটি ফেলা হয়েছে।
সড়কের দুই পাশে প্রশস্তকরণের কাজে নিম্নমানের ইট ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসকল ইট সামান্য আঘাতেই ভেঙ্গে যাচ্ছে বলে অভিযোগ প্রত্যক্ষদর্শীদের। ভূইগড় কাজীবাড়ি এলাকায় সড়কটি প্রশস্তকরণ ও ড্রেণ নির্মাণ কাজে নিম্নমানের ইট ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এছাড়া ভরাট বালু ফেলার ফলে ওই স্থানটি ঠিকমতো রোলার দিয়ে রোলিং না করায় ভবিষ্যতে মাটি দেবে গিয়ে সড়কে ফাটল সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের। অনেক স্থানে ঠিক মতো পলিতিনে স্তুপের উপর ফের মাটি ফেলে কোনমতে কাজ চারাচ্ছে বলেও াভিযোগ করেছে স্থানীয়রা । কারণ এর আগেও নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে লিংক রোড সংস্কারের কারণে লিংক রোডে অসংখ্য টিউমার (স্থানে স্থানে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল) সৃষ্টি হয়েছিল। যে কারণে সড়কটিতে প্রায়ই দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটতো।
এদিকে সড়কটির চাষাঢ়া থেকে চাঁদমারী পর্যন্ত লিংক রোডের দুই পাশের জায়গা প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের। এই অংশে সড়কের দুই পাশে অসংখ্য দোকান রয়েছে যেগুলো এখনো উচ্ছেদ করা হয়নি। এছাড়া ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের বিপরীতে লামাপাড়ায় সড়ক ও জনপথের জমিতে গড়ে ওঠা নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল (নম) পার্ক এখনো উচ্ছেদ করা হয়নি।
প্রকল্পের ব্যবস্থাপক নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মেহেদী ইকবাল জানান, সড়কটি ৬ লেনে উন্নীতকরণ কাজ শুরু হওয়ার পরে তারা নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের কোন অভিযোগ এ পর্যন্ত পাননি। তারপরেও তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। প্রকল্পটির উপ-ব্যবস্থাপক নারায়ণগঞ্জ সড়ক উপ-বিভাগ-১ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শাখাওয়াত হোসেন জানান, ইটগুলো দেখতে নিম্নমানের ইট মনে হলেও এগুলো আসলে নিম্নমানের ইট নয়। এগুলো মেশিন মেইড ইট। তারা ল্যাবের মাধ্যমে ইটগুলো পরীক্ষা করে দেখেছেন।
প্রকল্পের কাজে ধীরগতির বিষয়ে তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ২ বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৩০-৩৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। চাষাঢ়া থেকে চাঁদমারী পর্যন্ত লিংক রোডের দুই পাশের জায়গা প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের। এখানে যেসব স্থাপনা রয়েছে সেগুলো অপসারণের বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে কয়েক দফা সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতনদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আজকেও সেনা ভবনে মিটিং করেছি। কিছু কাগজপত্র চেয়েছিল সেগুলো দেওয়া হয়েছে।
শীঘ্রই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতনের মধ্যে একটি মিটিং হবে। আশা করছি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সেই মিটিংটি হবে। সেই মিটিংয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। লামাপাড়ায় বেসরকারী নম পার্ক কেন উচ্ছেদ করা হয়নি এ বিষয়ে তিনি বলেন, এলাইনমেন্ট ধরে যেসব স্থাপনা পড়বে আমরা সবই ভেঙ্গে দিব।
তিনি আরও জানান, সড়কের নিচে ক্যাবল রয়েছে, তিতাস গ্যাসের লাইন গেছে, ইলেকট্রিক পোল রয়েছে। এগুলো অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগকে বিদ্যুতের কেবল ও পোল অপসারণের জন্য ৬ মাস পূর্বেই ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা ইতিমধ্যে টেন্ডার সম্পন্ন করেছেন। বিদ্যুৎ বিভাগের ঠিকাদার কয়েকদিন আগে আমাদের সঙ্গে প্রকল্পের স্থান ঘুরে দেখে গেছে। বিদ্যুতের কেবল ও পোল এবং তিতাসের লাইন অপসারণ হয়ে গেলে প্রকল্পের কাজ আরো দ্রুত গতিতে এগুবে।









Discussion about this post