করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশ যখন চরম দুরাবস্থার মুখোমুখি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জুড়ে তখন দুর্নীতির ছড়াছড়ি। শীর্ষ থেকে নিম্ন পর্যায়ের প্রায় সকল কর্মকর্তা প্রতিযোগিতা করে দূর্ণীতির মহোৎসব চালিয়ে যাচ্ছে !
সরকার পরিবর্তন হলেও স্বাস্থ্য খাতের দূর্ণীতিবাজদের কোন পরিবর্তন দেখা যায় নাই। যুগের পর যুগ ধরে নারায়ণগঞ্জের একজন শীর্ষ ঠিকাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “দূর্নীতি আমরা করতে চাই না । ক্রসফায়ারে নিহত মমিন উল্লাহ ডেবিডকে প্রতিমাসে মাসোয়ারা দিতে হতো বিএনপির শাসনামলে, পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের শাসনামলে চার খলিফাখ্যাত এক প্রয়াত সন্ত্রাসী, শহরের একজন হাজি সাব, একজন এমপি কে এবং শাসক দলের হোমরা চোমরাদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়েই হাসপাতালের ঠিকাদারী ব্যবসা করতে হয়েছে । আর এই বিশাল অর্থ বন্টন করে ফারুক নামের এক নেতা ! এমপি, হাজি সাব ও হোমরা চোমরাদের অনৈতিক অর্থ এই ফারুক লেনদেন করে আসছিলো। ১৯৮৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিরামহীনভাবে একচ্ছত্র ঠিকাদারী করেছে এই চক্রটি । শুধিু নারায়ণগঞ্জই না কোদ মন্ত্রণালয়ের টেবিলে টেবিলে ঘুষ না দিলে ফাইল পরে তাকে পায়ের তলায় !”
(দীর্ঘ ২১ মিনিট ৫৭ সেকেন্ড মুঠোফোনে আলোচনাকালে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এই ঠিকাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার দূর্ণীতির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন)
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানোর বদলে, গত বছরের মার্চে দেশে মহামারি আঘাত হানার পর থেকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একটি অংশ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন।
এন ৯৫ মাস্ক কেনায় অনিয়ম, কোভিড পরীক্ষার ভুয়া সনদ, হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়ি চালকের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ বা মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে দুর্নীতির মতো বেশকিছু নেতিবাচক কারণে বারবার খবরের শিরোনামে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এসব কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তেই আছেন। কয়েকটি মামলা দায়ের ও মন্ত্রণালয়ে কিছু রদবদলের মধ্যেই এ ব্যাপারে নেওয়া সরকারি পদক্ষেপ সীমাবদ্ধ আছে।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি নজিরবিহীন। কিছু মানুষ এ মহামারিকে দুর্নীতির উৎসবে পরিণত করেছে। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে এটি সম্ভব হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পরও মহামারির শুরু থেকেই কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এটি আরও বেড়েছে। উল্টো দুর্নীতি রক্ষা ও প্রচারের চেষ্টা চালানো হয়েছে।’
সরকারের লাইসেন্স ছাড়াই যে অনেকগুলো বেসরকারি হাসপাতাল কার্যক্রম চালাচ্ছিল, রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির পর তা সামনে আসে।
রিজেন্টের লাইসেন্স ২০১৪ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ভালোভাবে জেনেও হাসপাতালটির সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চুক্তিপত্র সইয়ের অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থিতির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
ভুয়া কোভিড-১৯ সার্টিফিকেটের খবর কেবল জনস্বাস্থ্যের জন্যই ঝুঁকি ছিল না, প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও এটি সমস্যায় ফেলেছে। এ খবরে তখন অনেক দেশের দরজাই বাংলাদেশিদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
মহামারির শুরু থেকেই স্বাস্থ্য খাতের আরও যেসব বিষয় নিয়ে অভিযোগ ওঠেছে, তারমধ্যে গত বছর সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীদের ভুয়া এন৯৫ মাস্ক সরবরাহ এবং বিশ্ব ব্যাংক ও এডিবির অর্থায়নে জরুরি কোভিড-১৯ প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনা রয়েছে। এমনকি দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও (বিএসএমএমইউ) গত জুলাইয়ে নকল মাস্ক পাওয়া যায়।
এ ছাড়া, কোয়ারেন্টিন ও সরকারি হাসপতালগুলোর সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের খাবারের জন্য বরাদ্দ তহবিলেও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ফলে সরকারকে এসব সুবিধা স্থগিত করে দিতে হয়।
গত মাসে আড়াই হাজার মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের বহুল প্রতীক্ষিত নিয়োগেও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়।
করোনা পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু ওই সময়ের মহাপরিচালকসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। ওই সময়কার স্বাস্থ্য সচিব আসাদুল ইসলামকে জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। কেলেঙ্কারির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যান।
গত সেপ্টেম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়ি চালক আব্দুল মালেক গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনায় ওঠে আসেন। তদন্তকারীরা জানান, মালেক কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকার মালিক। তাকে ওই সময় কারাগারে পাঠানো হলেও, পরে আর এ মামলার কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ থেকে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটি সিন্ডিকেটের কারণেই স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা গতকাল গণমাধ্যম কে বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে পদ্ধতিগত একটি সমস্যার কারণেই সুসংগঠিত একটি সিন্ডিকেট প্রতিবার সুযোগ নিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটে নীতি নির্ধারকরা পর্যন্ত রয়েছেন।’
নিম্নমানের পিপিই ও নকল এন ৯৫ মাস্ক কেনার বিতর্কের মধ্যে গত বছরের ২৩ মে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদুল্লাহকে সেনা সদর দপ্তরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
দায়িত্ব ছাড়ার আগে গত ৩০ মে শহিদুল্লাহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেন, স্বাস্থ্যখাতের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি একটি সিন্ডিকেট।
গত বছর কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
দুদকের তদন্ত
গত বছরের ১৮ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বহুল আলোচিত দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিন দিন পর মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজার, আইসিইউ সরঞ্জাম, ভেন্টিলেটর, পিসিআর মেশিন ও টেস্ট কিট সংগহে গৃহীত প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে বিশদ তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় দুদক। নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালের দূর্ণীতির বিষয়েও দূদকের দপ্তরে একাধিক পত্র পাটানো হলেও সেই পত্র গায়েব হয়ে গেহছে বলেও চাউর রয়েছে নগরজুড়ে।
তদন্তের অংশ হিসেবে দুদক মার্চ মাসের শেষ দিকে থেকে বিভিন্ন স্থানে বদলি হওয়া ডাক্তারদের ব্যাপারেও মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য চায়।
এর আগে, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে সতর্ক বার্তাসহ ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে একটি প্রতিবেদন পাঠায় সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের যথাযথ তদারকির অভাবের সুযোগে ওষুধ, সার্জিক্যাল সরঞ্জাম ও মেশিন কেনায় দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের একটি চক্র ‘অর্থ আত্মসাতের জন্য অনেক অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কিনে থাকে’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে দুদক দুর্নীতি ও এ খাতের অন্যান্য অনিয়ম রোধে ২৫টি সুপারিশও উপস্থাপন করে। কিন্তু এসব সুপারিশের অধিকাংশই কানে তোলেনি মন্ত্রণালয়। গত বছরের জুনে মন্ত্রণালয় কেবল ১৪টি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
সুপারিশ কার্যকর করা হয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে সবশেষ গত মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে চিঠি দেয় দুদক।
এ ব্যাপারে যোগযোগ করা হলে দুদকের সচিব মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ে তদারকির এখতিয়ার না থাকায়, আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে চিঠিটি দিয়েছি। এখনো এর কোনো উত্তর পাইনি।’
কয়েক দফা চেষ্টা করেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।









Discussion about this post