কখনো স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের পাশে দাড়িয়ে ছবি তুলে প্রচার, কখনো কাউন্সিলর কবির হোসেন, কখনো সাবেক কাউন্সিলর কামরুল হাসান মুন্না, সংরক্ষিত নারী আফসানা আফরোজ ভিভার সাথে ছবি তুলে বিভিন্নভাবে প্রচার চালিয়ে নিজের মাদক ব্যবসা নির্বিঘ্নে পরিচালনা করে আসছিলো কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন বিটু ।
বিগত সময়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার পুলিশ পিটিয়ে ভারতে পলাতক থেকে নারায়ণগঞ্জের একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির বিয়ায়ের মাধ্যমে ফের পুলিশের কর্তাদের নিয়মিত মাসোহারা দেয়ার চুক্তিতে দেশে ফিরে রমরমা কারবার শুরু করে বিটু । এই বিটু ছিলো অপ্রতিরোধ্য মাদক ব্যবসায়ী ।
বিটুর মাদক ব্যবসায় নির্বিঘ্নে পরিচালনা করতে শাসক দলের চেলাচামুন্ডাদের পাশাপাশি বিএনপি নেতা, বিশেষ পেশার অসাধু চক্র ও আইনশৃশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই নিয়মিত মাসোহারা গ্রহণ করতো বিটুর কাছ থেকে ।
এমন অসংখ্য ঘটনার পর এবার নারায়ণগঞ্জ শহরের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন বিটুকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠিয়েছে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
বুধবার (১২ জানুয়ারি) দুপুরের দিকে তাকে রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে প্রেরণ করে ডিবি।
এর আগে ১১ জানুয়ারি রাতে শহরের নিতাইগঞ্জ থেকে র্যাব-১১ সালাউদ্দিন বিটুকে আটক করে। পরে তাকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি মামলায় জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
সালাউদ্দিন বিটু নিতাইগঞ্জ শীতলক্ষ্যার নলুয়া এলাকার আবিদ আলী চৌধুরী ওরফে হাবলু চৌধুরীর ছেলে। এবং একটি প্রভাবশালী পরিবারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগি। বর্তমানে সে কাউন্সিলর প্রার্থী কামরুল ইসলাম মুন্নার পক্ষে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় ছিল। এছাড়াও সে স্বতন্ত্রপ্রার্থী তৈমূল আলম খন্দকারের হাতি প্রতীকের পক্ষেও ভোট চেয়ে প্রচারণা করছিলো।
সালাউদ্দিন বিটুর গ্রেফতারের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওসি (পশ্চিম) ফখরুদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি জানান, র্যাব তাকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি মামলায় আটক করে। মামলাটি আমরা তদন্ত করছি। সেই মামলায় র্যাব তাকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। এই মামলায় তাকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠিয়েছি। তিনি আরও জানান, বিটুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। সে একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী।
সূত্র জানায়, শহরের শীতলক্ষ্যা, নলুয়া ও বাপ্পী চত্বর এলাকার শীর্ষ মাদক কারবারি সালাউদ্দিন বিটুর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট রয়েছে। জেলার অন্যতম শীর্ষ মাদক বিক্রেতা হিসেবে বিটুর খ্যাতি রয়েছে।
এর আগে ২০২০ সালের ৪ মার্চে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশের একটি টিম তাকে আটক করে। ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ শহরের নিতাইগঞ্জ তামাকপট্টি এলাকার শুক্কুর মিয়ার রিকশার গ্যারেজ থেকে ডিবির হাতে সে আটক হয়েছিল। একই বছরের ১৯ আগস্ট বিটুকে সাড়ে ৩০০ পিস ইয়াবাসহ তামাকপট্টি থেকে গ্রেফতার করে ডিবি। বিটু এর আগেও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কদমতলী থানায় সাড়ে ৫০০ পিস ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হয়। এর আগের বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সালাউদ্দিন বিটুর সেকেন্ড ইন কমান্ড বুইট্টা সুজন, শাহীন ও আরিফকে ৬০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক করে সদর মডেল থানা পুলিশ। এরপর গা-ঢাকা দেয় মাদক বিক্রেতা সালাউদ্দিন বিটু। পরবর্তীতে তিনি আবারো এলাকাতে ফিরে আসে।
সূত্র আরও জানায়, সালাউদ্দিন বিটুর নেতৃত্বে রয়েছে নারীসহ অন্তত ডজনখানেক মাদক কারবারি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছে, অমি হাসান, নজরুল ইসলাম বাবু ওরফে কমলেট বাবু, রুবেল ওরফে মামা রুবেল, সাফোয়ান ইসলাম জয়, সাঞ্জু আক্তার, জামাই মাসুদ এবং মিলন চৌধুরী ও রনি চৌধুরী প্রমূখ।
সূত্র জানায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়াতে রয়েছেন সালাউদ্দিন চৌধুরী বিটু। তার এই মাদকের কারবারের সাথে পার্টনার ছিল ইব্রাহিম নামক এক যুবক। পরে তারা দুজন ভাগ হয়ে পৃথক ভাবে মাদকের কারবার শুরু করে। তাদের মধ্যে ইব্রাহীম জামতলা, আমলাপাড়া এবং ফতুল্লা অংশে এবং সালাউদ্দিন চৌধুরী বিটু শহরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নলুয়া, নিতাইগঞ্জ এবং বাপ্পী চত্বর এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে বসেন। তবে, বিটু ব্যবসার কৌশল পরিবর্তন করে খুচরা বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে পাইকারি ব্যবসায় নাম লেখান। এই ব্যবসা চালিয়ে যেতে নিজে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডকেটের সদস্যদের মাধ্যমেই জেলার বিভিন্ন স্থানে মাদকের চালান পৌঁছে দিয়ে আসে।
সূত্র জানায়, বিটু সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য নলুয়াপাড়া বাপ্পি চত্ত্বর এলাকার নজরুল ইসলাম বাবু ওরফে কমলেট বাবু। বর্তমানে সে তামাকপট্টি, সোলেমান সিকদারের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। সন্ত্রাসী এতিম সুজনকে হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় পৃথক পৃথক সময়ে সে গ্রেফতারও হয়। বাবু বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছে। তবে, বাবুর অবর্তমানে বিটু বাহিনীর হয়ে কাজ চালিয়ে নিত তার স্ত্রী সাঞ্জু আক্তার। মূলত এই সাঞ্জুই ইয়াবা শরীরে বহন করে চাহিদা মত বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিয়ে আসতেন। সঞ্জু আক্তার, মামা রুবেল ও সাফোয়ান এক হাজার পিস ইয়াবার চালান কাশিপুর হাটখোলা পৌঁছে দিতে গেলে ফতুল্লা থানা পুলিশের হাতে আটক হন। তবে, ওই সময় পালিয়ে যায় মামা রুবেল।
সূত্র জানায়, সালাউদ্দিন বিটু সিন্ডিকেটের আরেকজন দুর্ধর্ষ মাদক কারাবারি হচ্ছেন জামাই মাসুদ। শহরের নলুয়া পাড়া এলাকার মৃত সুলতানের ছেলে জামাই মাসুদ মাদকসহ একাধিকবার গ্রেফতারও হয়েছিল। তার সহযোগি হিসেবে কাজ করে পাইকপাড়া জল্লারপাড়া এলাকার নিজামউদ্দিনের ছেলে মো. সজিব এবং দুই নং বাবুরাইল এলকার আলমাছের দুই ছেলে মো. আল রাজু ও আল রাহাত। এছাড়াও বিটু সিন্ডিকেটের আরও দুই সদস্য হচ্ছে মধ্য নলুয়াপাড়া এলাকার মিলন চৌধুরী ও রনি চৌধুরী। ২০১৯ সালে শীর্ষ এই দুই মাদক বিক্রেতাসহ বিটুর বাড়িতে অভিযান চালায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ। ওই সময় তাদের না পেয়ে এই মাদক কারবারিদের বাড়ির আসবাব পুড়িয়ে দিয়েছিল পুলিশ। বিটু, মিলন, রনিসহ এই সিন্ডিকেটের প্রত্যেকেই একাধিকবার মাদকসহ গ্রেফতার হলেও তাদের মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়নি। সূত্র জানায়, বর্তমানে শহরের সব থেকে বড় মাদকের ডিলার ওই সালাউদ্দিন বিটু।








Discussion about this post