ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান মঙ্গল শোবাযাত্রায় যোগ দিতে বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি তে উপস্থিত হয় শিশু টি ।
এরপর পহেলা বৈশাখে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচারে এক শিশুর বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রল চলছে৷ প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকতার নীতিমালা ও সংবাদমাধ্যমে একতরফা প্রচারের যৌক্তিকতা নিয়েও ৷ প্রশ্ন উঠেছে পারিবারিক শিক্ষাসহ তেলবাজির একটি উদহারণ হিসেবে । অনেকেই নানাভাবে দেখছেন শিশুর এই বক্তব্য । চলছে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনারও কমতি নেই।
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ‘‘কেমন লাগছে এখানে এসে, কোনটা বেশি ভালো লাগছে?’’- এমন একটি প্রশ্নের জবাবে শিশুটি বলেছে, ‘‘ভালো লাগছে৷ পহেলা বৈশাখ মানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ পহেলা বৈশাখ মানে…৷’’ এরপর অবশ্য লাইভে থাকা সাংবাদিক মাইক্রোফোন সরিয়ে আরেক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করেন৷
লাইভ সম্প্রচারের পর ১৭ সেকেন্ডের ওই ভিডিও ক্লিপটি নিয়ে ব্যাপক ট্রল হচ্ছে৷ শিশুটিকে নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করা হচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, ওই ভিডিও ক্লিপের সঙ্গে কেউ কেউ আপত্তিকর মন্তব্য জুড়ে দিয়ে, ভয়েস বিকৃত করে নতুন নতুন ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়ছে ৷
এই পরিস্থিতিকে তিনটি দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন সাংবাদিক, শিশু মনোবিদ, ইতিহাসবিদ এবং শিক্ষাবিদরা৷ তা হলো-
১.সাংবাদিকতার নীতিমালা
২.শিক্ষা সংকট এবং
৩. বঙ্গবন্ধুকে এক সময় অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করার পর এখন অতি প্রচার ৷
সাংবাদিকতার নীতিমালা কী বলছে ?
গ্লোবাল টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা মনে করেন, এখানে শিশুটিকে নিয়ে ট্রল করা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না৷ সে একটি বিষয় জানতে পারে আবার নাও জানতে পারে৷ যারা ট্রল করছেন তারা অন্যায় করছেন ৷ তারা ভেবে দেখছেন না এই শিশুটি কতটা কষ্ট পাচ্ছে ৷ তাদের পরিবার কতটা কষ্ট পাচ্ছে ৷ তারা ভেবে দেখছেন না এটা যদি তাদের পরিবারের কাউকে নিয়ে হতো তাহলে তারা কীভাবে নিতেন ৷
তিনি বলেন, ‘‘আর সাংবাদিকদের ভিতরে একটা প্রবণতা আছে তারা কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেটা পাবলিক পরীক্ষা হলেও শিশু দেখলেই ক্যামেরটা তার দিকে নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা ৷
সাংবাদিকতা নীতি অনুযায়ী শিশুদের দিকে ক্যামেরা তাক করাই একটি অনুচিত কাজ৷ যদি খুব প্রয়োজন হয় সাংবাদিক এবং পুলিশ যদি শিশুদের কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে তার অভিবাবকের অনুমতি নিতে হবে ৷ আবার অনেক সময় অভিবাকরাও চান তার শিশু সন্তানের ছবি বা বক্তব্য প্রচার করা হোক ৷ এখানেও সাংবাদিকের কাজ হলো তাদের নিরুৎসাহিত করা ৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘এজন্য প্রত্যেকটি সংবাদমাধ্যমে একটা গাইডলাইন থাকা উচিত৷ আর যারা ফিল্ডে কাজ করেন তাদেরও বিষয়টি জানা উচিত ৷’’
শিশুটির ওপর মানসিক চাপ পড়ছে :
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মনো চিকিৎসক ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আমিও ভিডিওটি দেখেছি এটা সত্য, না এডিটেড আমি জানিনা৷ তবে এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করা, শিশুটিকে প্রশ্ন করা, মূল গণমাধ্যমে দেখানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি৷ এটা শিশুর মনের ওপর একটি প্রভাব ফেলবে৷ এখানে শিশুটির অধিকার ক্ষুন্ন করা হচ্ছে৷’’
তার মতে, ‘‘এখানে শিশুটির কোনো দায় নেই৷ তার শিক্ষায় ত্রুটি আছে৷ তাকে শিক্ষার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে৷ তাকে যা শেখানো হচ্ছে, তার বাইরে যে আরো কিছু বিষয় নিয়ে জানা দরকার সেটা তাকে শিখানো হচ্ছে না৷’’
সংকট কোথায় ?
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘‘এই দেশের জন্ম বঙ্গবন্ধুর হাতে হয়েছে, তিনি দেশের জনক- এই কথাগুলো ঠিক আছে ৷ কিন্তু এখন একটা প্রবণতা হয়েছে যে-কোনো ভালো কিছু হলেই বঙ্গবন্ধুর নামে চালিয়ে দেয়া ৷ এই প্রবণতার কারণে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে৷ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজ নামচা কত জন জানেন ? এমনকি যারা তার আদর্শের অনুসারী, তাদের কতজন পড়েছেন? তার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তাকে শ্রদ্ধা জনাতে হবে ৷ তার সম্পর্কে না জেনে এভাবে কথা বলে লাভ নেই৷ তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বঙালি, তার কাজই তাকে শ্রেষ্ঠ করেছে ৷ তাকে নিয়ে তিনি যা করেননি তা বলার দরকার নেই ৷’’
তিনি বলেন, ‘‘একসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চর্চা অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল৷ আর এখন তার সম্পর্কে না জেনে অনেকে অনেক কিছু বলছেন৷ তাকে ভালোভাবে জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ ৭৫-এর ১৫ আগষ্টের পর আমাদের যে প্রতিবাদ করার কথা ছিল, আমরা তখন তা করিনি ৷ এখন আবার না জেনে অনেক কিছু বলছি ৷’’
তার কথা, ‘‘ওই শিশুটির তো কোনো দোষ নেই৷ তাকে যেভাবে শেখানো হয়েছে, সে সেভাবেই বলেছে৷ কিংবা আশপাশে যেভাবে শুনেছে, সেভাবেই বলেছে ৷’’
ইতিহাসবিদ আফসান চৌধুরী মনে করেন, শিশুটি যা বলেছে এটাকে এত সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই, ‘‘একটি বাচ্চা কোথা থেকে শিখেছে, কীভাবে শিখেছে জানি না৷ হয়তো তার পরিবার থেকে শিখেছে৷ তার পরিবারে ওইভাবে বলা হয় ৷ তবে এটা নিয়ে যে পরিমাণ ট্রল হচ্ছে, হাসাহাসি হচ্ছে, এর কোনো মানে হয় না৷ সব বাচ্চা তো এরকম বলে না৷ আমরা সবাইকে এভাবে বলতে শুনিনি ৷ ফলে ওই শিশুটি যে প্রতিনিধিত্বশীল তা বলা যাবে না৷ আর সাংবাদিক কেন প্রশ্ন করেছে, সেটা সে-ই বলতে পারবে ৷’’
তিনি বলেন, ‘‘পহেলা বৈশাখ নিয়েও এ বছর যে পরিমাণ রাজনীতি হচ্ছে, এর আগে আমরা এত রাজনীতি দেখিনি৷ আমদের সময় হলে তো এটাকে (শিশুর জবাব) কেউ পাত্তাই দিতো না ৷ সিরিয়াসলি নিতো না৷ এখন সমাজের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে, দুশ্চিন্তা বাড়ছে, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দল খুব সংঘাতপূর্ণ অবস্থানে চলে যাচ্ছে, সেই জন্য এখন প্রতিটি বিষয় এবং প্রতিটি উচ্চারণই রাজনৈতিক হয়ে যাচ্ছে৷ রাজনৈতিকভাবে নেয়া হচ্ছে ৷’’
তার কথা, ‘‘আমার ধারণা ওই বাচ্চাটা পহেলা বৈশাখও বোঝে না, শেখ মুজিবুর রহমানও বোঝে না৷ সে হয়ত তার পরিবারে বা স্কুলে যা শুনেছে, তা বলেছে৷ এই বাচ্চাটির কথা নিয়ে যে ট্রল বা হাসাহাসি হচ্ছে এটা বিভাজিত রাজনীতির সূচক৷ বাচ্চাটি কী বলেছে সেটা কোনো সূচক না৷’’
সূত্র : Deutsche Welle









Discussion about this post