আওয়ামীলীগের হাল ধরে শেখ হাসিনা প্রথম সরকার গঠন করে ১৯৯৬ জুন মাসে । সেই সময় জাতীয় সংসদের সর্ব কনিষ্ঠ সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন শামীম ওসমান। ১৯৯৬ সালের জুন থেকে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫ বছর ক্ষমতাসীন অবস্থায় শামীম ওসমানের চার খলিফাখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী মাকসুদ – সারোয়ার – লাল (প্রয়াত) ও নিয়াজুলসহ তাদের বাহিনী সব সময় অস্ত্র প্রদর্শন করে চলাফেরা করতো পুরো জেলা । একই সাথে ওই ৫ বছর কুখ্যাত সন্ত্রাসী মিঠু ওরফে অগা মিঠু, শাহ নিজাম, হেলাল, সাজনুসহ আরো কয়েকজন প্রকাশ্যেই খোলা জিপে অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করে নগরবাসীকে আতংকের মধ্যে রাখতো।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে পরাজয় বরণ করে রাতের আধারে বোরকা পড়ে মাইক্রো বাসে করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় শামীম ওসমান ও তার পুরো পরিবার। এরপর ওই শীর্ষ সন্ত্রাসী মাকসুদ – সারোয়ার – লাল (প্রয়াত) ও নিয়াজুল, মিঠু ওরফে অগা মিঠু, শাহ নিজাম, হেলাল, সাজনুসহ অন্যান্যদের হাতে থাকা সেই অস্ত্র আর উদ্ধার হয় নাই ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কোন সরকারের শাসনামলেই ।
ওই সময় শামীম ওসমান সারা দেশে গডফাদার হিসেবে উপাধি লাভ করে । যা এখনো দেশের মানুষ গডফাদার বলতে প্রথমেই শামীম ওসমানকেই মনে করে । যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে মামীম ওসমানের চাইতেও অনেক বড় মাপের কুখ্যাত অপরাধী বিগত ১৫ বছরে দাবড়িয়ে বেড়িয়েছে পুরো দেশ বিদেশ । তবুও তাদের কেউ আর গডফাদারের উপধি লাভ করতে পারে নাই ।
এবার সেই ২০০১ সালের পর আবার কোটা সংঙ্কারের দবিতে গঠন হওয়া বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন যখন শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রূপ নিলে গডফাদার শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্য এবং চেলা চামুন্ডাদের নিয়ে অস্ত্রের মহড়া দেন প্রকাশ্যেই।
সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জও একই দাবিতে যখন উত্তাল তখন নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমান তার বাহিনী নিয়ে মাঠে নামেন এবং নির্বিচারে ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণ করেন। অস্ত্রের ঝনঝনানিরে চিত্র দেখে শিহরে উঠে নারায়ণগঞ্জবাসী ।
বিভিন্ন ভিডিও চিত্র ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ১৮ ও ১৯ জুলাই শামীম ওসমানের নেতৃত্বে তার ছেলে উঠতি গডফাদার অয়ন ওসমান, শ্যালক তানভির আহম্মেদ টিটু, বেয়াই ফয়েজউদ্দিন লাভলু, পুত্রা ভিকি, সাংবাদিক রাজু আহম্মেদ, মোবারক হোসেন খান কমল, কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু, তার ছেলে রিয়েন, ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদ, রাফেল, মেহেদী হাসান সম্রাট, শান্ত, খান মাসুদসহ প্রায় দুই শতাধিক সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে। তারা ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি ছুড়ে।
তাদের ছোড়া গুলিতে রিয়া গোপ, রাসেল মিয়া, স্বজন, পারভেজ, রাকিবসহ অসংখ্য মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আন্দোলন চলাকালে শামীম ওসমান বাহিনীর হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্তত দেগশতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গিয়েছিল। এতসংখ্যক অস্ত্র ইতোপূর্বে একসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের মানুষ কখনই দেখেনি। অনেকের মতে, এতসংখ্যক অস্ত্র দিয়ে একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করা সম্ভব। দীর্ঘদিন ধরে তারা এসব অস্ত্র নিজেদের কাছে মজুদ করে রেখেছিলেন। আর এসব অস্ত্রই ছিল অবৈধ। তবে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর শামীম ওসমানসহ তার বাহিনীর অনেকেই নারায়ণগঞ্জ ছাড়েন। এরমধ্যে কেউ কেউ দেশের বাইরে যেতে পারলেও অনেকেই বিভিন্ন জেলায় আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সকলের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে এক এবং একাধিক হত্যা মামলাও জেলার বিভিন্ন থানায় দায়ের হয়।
এদিকে ওসমান বাহিনীর অস্ত্রধারি সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে চলে গেলেও ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালানো সেসব অস্ত্রগুলো কোথায় ? সে সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। এসব অস্ত্রের সন্ধান বের করে তা উদ্ধার করা জরুরী বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক সমাজ।
নগরীর জনসাধারণের মতে, ওসমানী সাম্রাজ্যের সন্ত্রাসীরা পালিয়েছে। কিন্তু তারা পালালেও তাদের সঙ্গে সেসব অস্ত্র নিয়ে যায়নি যেসব অস্ত্র দিয়ে সেদিন তারা তাণ্ডব চালিয়েছিলেন। এসব অস্ত্র এখনও নারায়ণগঞ্জে তাদের দোসরদের কাছে সুরক্ষিত রয়েছে। কেননা, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অনেক দোসর এখনও এই শহরেই ঘাপটি মেরে আছেন। এসব দোসররা রঙ বদলে এখনও ওসমান পরিবারের জন্যই কাজ করে যাচ্ছে, তাদের নির্দেশ, আদেশ পালন করে যাচ্ছেন। সময়মত এরা ঠিকই ফণা তুলবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করেন, গডফাদার শামীম ওসমানের দোসররা যে সেক্টরেই থাকুক তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা, এরা স্ব স্ব অবস্থানে অধিষ্ঠিত থাকা মানেই ওসমানদের হয়ে ওসমানীয় সাম্রাজ্য রক্ষা করাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য হবে। ফলে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সংগঠনÑ যেখানেই ওসমানীয় দোসর থাকুক তাদেরকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
ওসমান পরিবারের সাম্রাজ্যের অনেক দোসর এখন ভোল পাল্টে বিএনপির ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ সেই আশ্রয়ও পেয়েছেন। এসব ব্যক্তিরা বিএনপি ও এর সহযোগি সংগঠনের নেতাদের সামনে এগিয়ে রেখে ব্যবসা বাণিজ্য বহাল রেখেছেন। বিশেষ করে ফতুল্লার বিসিক এবং আদমজী ইপিজেডে এখনও ওসমানীয় দোসরদের আনাগোণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়াও বেশ বদলে তাদের কোনো কোনো দোসর ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাও হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ এখনও কোনো কোনো ব্যবসায়ী সংগঠনের পদ আকড়ে আছেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ব্যবহৃত অবেধ অস্ত্র এবং গত ১৫ বছর অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ওসমান পরিবারের সাম্রাজ্যের অস্ত্রের ভাণ্ডার যদি উদ্ধার করা না যায় তাহলে এসব অস্ত্র দিয়ে তারা আবারও ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণ করবে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবেন। ফলে সে সুযোগ যেন তারা না পায় সেজন্য এসব অস্ত্র উদ্ধার অত্যান্ত জরুরী। নইলে নগরবাসীর মাঝে ভয় ও শংকা থেকেই যাবে আবার রিয়া গোপ, রাসেল মিয়া, স্বজন, পারভেজ, রাকিবের মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে কিনা !









Discussion about this post