আনসার আল ইসলামের প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান এবং ঢাকা, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে সাইবাসহ এই সংগঠনের সক্রিয় ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
রোববার (১০ ডিসেম্বর) রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
সোমবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন হলো- মো. শরিফুল ইসলাম ওরফে মুরাদ (৩১), আশিকুর রহমান ওরফে উসাইমান (২৭), মুহাম্মদ জাকারিয়া ওরফে আবরার(২৪), মো. আল আমিন ওরফে রবিন ওরফে সামুরা (২৪) ও মো. আবু জর মারুফ (১৮)। গ্রেফতারকালে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী ও উগ্রবাদী বই এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানান, গ্রেফতারকৃতরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ এর সদস্য। তারা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল কায়েদা মতাদর্শের জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ এর কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যদেরকে তারা বিভিন্ন উগ্রবাদী পুস্তিকা, মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতো।
এছাড়াও তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন মাদ্রাসা ও সদস্যদের নিকট থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতো। বিভিন্ন সময়ে তারা মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করতো। এছাড়াও তারা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতেন এবং তারা সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণ করতো।
তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃত আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ইসহাক ওরফে সাইবা দাখিল সম্পন্ন করে। সে ২০১৫ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উগ্রবাদী উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে। সংগঠনে যোগদানের পর সে বিভিন্ন পেশার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে সে সংগঠনের রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক এবং প্রশিক্ষণ শাখার প্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। তার সাথে আনসার আল ইসলাম এর বর্তমান আমিরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে এবং তার নির্দেশেই তিনি রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল।
সে অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ও জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করতো। তার নির্দেশে সংগঠনের নতুন সদস্যদের গাজীপুর, টঙ্গি ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন আনসার হাউজে তাত্ত্বিক ও শারীরিক কসরতসহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গোপনীয় অ্যাপস ব্যবহার করে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য সদস্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো ও শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নিকট হতে নির্দেশনা নিতো এবং সংগঠনে তার অনুসারীদের সকল প্রকার দিকনির্দেশনা দিতো।
এছাড়াও সে সংগঠনের সদস্যদের কাট আউট সিস্টেম সম্পর্কিত বিষয়ে মৌখিক এবং লিখিত প্রশিক্ষণ প্রদান করতো এবং কাট আউট সিস্টেম এর নীতিমালা মেনে চলার নির্দেশনা দিতো বলে জানায়। সে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গোপন অ্যাপস এর মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতো। তার নির্দেশনায় গ্রেফতারকৃত শরিফুল সংগঠনের বেশকিছু সদস্যকে তথাকথিত হিজরত ও বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে ছিল বলে জানায়। সাইবার নির্দেশনায় পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণকৃত ৪ জন সদস্য এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়। সে কাশেমপুর কারাগারে গ্রেফতারকৃত আনসার আল ইসলামের সদস্যদের সাথে নিয়মিত দেখা করতো এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেখা করিয়ে দিতো বলে জানা যায়। এছাড়াও সে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় করায় সংগঠনটির অন্যতম সমন্বয়ক সাইবা হিসেবে পরিচিত পায়।
সংগঠনের হিজমা ডাক্টার আশিকুর: র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারকৃত আশিকুর রহমান একজন কুরআনের হাফেজ। সে ময়মনসিংহ এলাকায় হিজামার ব্যবসা করতো বলে জানা যায়। সে ২০১৮ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উগ্রবাদী উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে দাওয়াতি কার্যক্রম করতে থাকে। পরবর্তীতে সে সংগঠনের ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম প্রধান সেকশন চীফ হিসেবে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পাশাপাশি সে সংগঠনের জিহাদী প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে অন্যতম সমন্বয়ক ছিল বলে জানা যায়। সে নতুন সদস্যদের সংগঠন ও তথাকথিত জিহাদ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য উগ্রবাদী পুস্তিকা সরবরাহ করতো। গ্রেফতারকৃত সাইবা এর নির্দেশনায় সে সংগঠনের মাসুলদের অধীনস্থ হিসেবে নতুন সদস্যদের বণ্টন করার দায়িত্ব পালন করতো বলে জানা যায়। সে সংগঠনের বিভিন্ন সদস্যদের কারাতে প্রশিক্ষণ ও শারীরিক কসরত সম্পর্কিত বিষয়সমূহে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতো এবং প্রশিক্ষণকালীন সময় শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা প্রদান করতো বলে জানায়।
সংগঠনের কারাতে প্রশিক্ষক জাকারিয়া: কমান্ডার আল মঈন বলেন, গ্রেফতারকৃত জাকারিয়া ওরফে আবরার স্থানীয় একটি মাদ্রাসা হতে হাফেজী পড়া সম্পন্ন করে। সে ২০২০ সালে সংগঠনের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে উগ্রবাদী উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে। সে ভ্রাম্যমাণ রকমারি ব্যবসার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম ও নতুন সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনা করতো বলে জানা যায়। পরবর্তীতে সে রাজধানীর আশুলিয়া, সাভার এবং মানিকগঞ্জ জেলার সংগঠনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। সে গ্রেফতারকৃত আশিকুর রহমান এর নির্দেশে কারাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং ব্যালাকবেল্ট অর্জন করে। পরবর্তীতে সে গ্রেফতারকৃত সাইবা এর নির্দেশে সংগঠনের সদস্যদের সাভার ও গাজীপুর, টুঙ্গির বিভিন্ন আনসার হাউজে শারীরিক (কারাতে) প্রশিক্ষণ প্রদান করত। এছাড়াও সে নতুন সদস্য সংগ্রহসহ সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গোপনীয় এ্যাপস এর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করতো।
অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতেন শরিফুল: আম মঈন বলেন, গ্রেফতারকৃত শরিফুল স্থানীয় একটি হাফিজীয়া মাদ্রাসা হতে হেফজ সম্পন্ন করে। সে ২০১৮ সালে গ্রেফতারকৃত সাইবার মাধ্যমে উগ্রবাদী উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে দাওয়াতি কার্যক্রম করতে থাকে। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত সাইবার নির্দেশে সে সংগঠনের ০৪ জন সদস্যসহ ২০১৯ সালের প্রথম দিকে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও তথাকথিত জিহাদের জন্য অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে গমন করে। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের শেষের দিকে সে অন্য সদস্যদের রেখে কৌশলে অবৈধ পথে বাংলাদেশে ফেরত আসে। বাংলাদেশে আসার পর সেখানে অবস্থানরত সংগঠনের সদস্যদের সাথে সে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতো এবং পুনরায় সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতো বলে জানায়। সে গ্রেফতারকৃত সাইবার নির্দেশনায় সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত হিজরত ও প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণ করতো। সে সংগঠনের সদস্যদের বিভিন্ন দেশে প্রেরণের জন্য বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতো। এছাড়াও সে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে সভার আয়োজন করতো বলে জানা যায়। সে তথাকথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রেরণের জন্য সদস্য নির্বাচন ও প্রেরণ কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতো।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ সরবরাহ করতেন আল আমিন: র্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেফতারকৃত মো. আল আমিন ওরফে রবিন ওরফে সামুরা স্থানীয় একমটি মাদ্রাসা হতে দাখিল সম্পন্ন করে। সে ২০১৯ সালে রাকিব এর মাধ্যমে উগ্রবাদী উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলাম সংগঠনটিতে যুক্ত হয়। সে মাদ্রাসায় শিক্ষকতার আড়ালে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে সে ২০২১ সালে আনসার আল ইসলাম এর পক্ষ থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র জন্য পার্বত্য এলাকায় মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের কাজ করতো। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অর্থ শাখার প্রধান গ্রেফতারকৃত মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। সে মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব এর নির্দেশে কেএনএফ এর প্রশাসন ও অর্থ শাখার পাসেন মিরাম নামক ব্যক্তির নিকট মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রেরণ করতো বলে জানা যায়। এছাড়াও তার সাথে কুকি চীন এর নেতৃস্থানীয়দের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়।
ভ্রাম্যমাণ ব্যবসার আড়ালে দাওয়াতি কাজ করতেন আবু জর: র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত মো. আবু জর ওরফে মারুফ স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় জালালাইনে অধ্যয়নরত। সে ২০২২ সালে গ্রেফতারকৃত জাকারিয়া এর মাধ্যমে উগ্রবাদী উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘আনসার আল ইসলাম’ সংগঠনটির সাথে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে সে গ্রেফতারকৃত জাকারিয়ার নিকট হতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং ভ্রাম্যমাণ রকমারি ব্যবসার আড়ালে তার নিজ এলাকায় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতো।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানায় র্যাবের এই কর্মকর্তা।









Discussion about this post