গত কয়েকদিন যাবৎ নারায়ণগঞ্জের হেফাজত ইসলামের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে নানা সমালোচনার ঝড় বইছে নগরীজুড়ে। আলেম ওলামাদের নিয়ে কেউ তেমন সমালোচনা না করলেও বিভিন্ন সময় নানা কর্মকান্ডে ধর্মীয় গোষ্ঠির নেতাদের নিয়ে চলে সমালোচনা । ধর্মীয় শিক্ষার চাইতে অনেকেই ক্ষমতা প্রদর্শন ও আধিপত্য বিস্তার করতেই নানা ঘৃন্য কর্কান্ডের পর এবার নগ্ন ভাষায় আপত্তিকর অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ঘিরে ব্যাপক সমালোচনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর অনেকেই বলেছেন, “আমার তাহলে কি শিখবো আর পরবর্তী প্রজন্ম এদের কাছ থেকে কি শিখবে ? এবার লেবাসের আড়ালে আসলে কি করে ? এদের তো ঘৃণা করতেও ঘৃনা হয়।“
জানা যায়, মহানগর জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা কামাল উদ্দিন দায়েমীর অশ্রাব্য গালিগালাজের অডিও ভাইরাল হয়েছে। একজন আলেম নামধারী ব্যক্তির মুখে এ ধরনের গালিগালাজ ভাইরাল হবার পর একটি ইসলামী দলের পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন তিনি, এমনটা মনে করছেন ইসলামী দলগুলো নেতাকর্মী সমর্থক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ।
তার অশ্রাব্য গালিগালাজ ও একজন ব্যক্তিকে হুমকি দেয়ার অডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। যা রীতিমত ইসলামী দলগুলোর নারায়ণগঞ্জের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের হতবাক করে তুলেছে।
অডিওতে ঐ ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে দায়েমী বলেন, কোন খা**র পোলা আছে, মাওলানা ফেরদাউস (নারায়ণগঞ্জ জেলা জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর হেফাজতে ইসলামের স্থগিত কমিটির সভাপতি) ছাড়া কোন খা**র পোলা আছে যে খা**র পোলারা মাওলানা ফেরদাউসের বিরুদ্ধে কইবো? তার মার…!!! (অপ্রকাশযোগ্য)…
একই অডিওতে ঐ ব্যক্তিকে অনেকটা হুমকি দিয়ে উনি বলেন, আপনার অবস্থা খারাপ হবে আপনি সাবধান হয়ে যান, আপনি নারায়ণগঞ্জে থাকতে পারবেন না।
এরকম আরো একাধিক ব্যক্তিকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে এই দায়েমীর বিরুদ্ধে।
জানা যায়, কামাল উদ্দিন দায়েমী গালাগালিতে যার নাম উচ্চারণ করেছেন সেই মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তিনি নানা অপকর্ম করেন। যেখানে সেখানে যার তার সামনে তিনি গালিগালাজ শুরু করেন। রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ইসলামিক বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সামনে তার এহেন গালি দেয়ার কথাও জানান অনেকে। হেফাজতে ইসলামের স্থগিত কমিটির সভাপতি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানকে তিনি আর্থিকভাবে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি একেএম সেলিম ওসমানের পক্ষে নির্বাচনী সমাবেশ করে ও প্রচার প্রচারণা চালিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর হেফাজতে ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান ও দায়েমী। সেই নির্বাচনী সমাবেশে সেলিম ওসমান ভোট চাইছেন ও পাশে দাঁড়ানো ফেরদাউসের ছবি ভিডিও বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে লাইভ হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছিল। সেই নির্বাচনী প্রচারণার ভিডিও এখনো আছে এসব মাধ্যমে।
বিপুল পরিমান অর্থ ওসমান পরিবার থেকে নিয়ে বিতর্কিত সেই নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা ও বন্দরের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালান ফেরদাউস। সেলিম ওসমানের সাথে নির্বাচনী সভায় একই মঞ্চে একাধিকবার দেখা গেছে এই হেফাজত নেতাদেরকে।
কামাল উদ্দিন দায়েমী ফতুল্লার গোল মোহাম্মদ সরদার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন। ইমাম থাকাকালীন ঐ এলাকায় এক ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে এলাকাবাসীর রোষানলে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে এ ঘটনায় তাকে মসজিদ থেকে চাকুরিচ্যূত করা হয়েছিল।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, তিনি বিভিন্ন ধরনের তাবিজ কবজের ব্যবসা করতেন। এলাকার বিভিন্ন বয়সী নারীদের পাশে বসিয়ে তাদের তাবিজ দেয়ার কথা বলে তিনি তাবিজের এ ব্যবসা করায় তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন ইসলামিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক এবং এলাকাবাসীর।
তার পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পাড়ি জমানোর পর নানা পথে রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন এই কামাল উদ্দিন দায়েমী। একজন ইমাম থাকাকালীন মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি করা এই দায়েমী এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন অনৈতিক উপায়ে তিনি এসব অর্থের মালিক হয়েছেন বলে জানা গেছে। তার এই উপার্জিত অর্থের সঠিক আয়ের উৎস তিনি দেখাতে পারবেন না। কিভাবে কোন উপায়ে এত অবৈধ অর্থের মালিক হলেন তিনি তাও জানতে চান অনেকে।
এদিকে দায়েমীর হুমকি ও গালির অডিও ভাইরাল হবার পর চারিদিকে নিন্দার ঝড় উঠেছে। জমিয়তে ওলামায়ে বাংলাদেশের মত একটি সংগঠনে এরকম অশ্রাব্য গালিবাজ আলেম নামধারী বহুরূপী ব্যক্তিদের ব্যাপারে সংগঠন দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এবং তাদের বহিস্কার না করলে সংগঠনের সম্মান ও অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সকলে।
যাকে বাঁচাতে বেপরোয়া গালিগালাজ, কে এই ফেরদাউস ?
নারায়ণগঞ্জ শহরে সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ছোট ভাই হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ফেরদাউস। অরাজনৈতিক সংগঠন হওয়ার পরেও ফেরদাউসের নির্বাচনী সভায় অংশ নেয়াতে হেফাজতের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনা দেখা গিয়েছিল সেসময়। নিজেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার আসামি দাবি করা ফেরদাউস ও তার অনুগতদের শামীম ওসমানের আশির্বাদে গ্রেপ্তার রিমান্ডের শিকার হতে হয়নি।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে হেফাজতকে কন্ট্রোলে রাখতে ফেরদাউস বিভিন্নভাবে সুবিধা নিয়েছেন শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানদের কাছ থেকে। আর্থিকসহ নানা সুবিধা নিয়ে বিগত সময়ে সরকারবিরোধী নানান আন্দোলনে হেফাজতকে নিষ্ক্রিয় রাখতে ভূমিকা পালন করেছেন ফেরদৌস।
ওসমান পরিবারের দুই প্রভাবশালী সদস্য শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানের সাথে মাওলানা ফেরদাউসের একাধিক ঘনিষ্ঠ ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে মাওলানা ফেরদাউসকে নিয়ে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক তৌহিদী জনতার ব্যানারে তার গ্রেপ্তার দাবি করে ব্যানার টানানো হয়েছে ৫ আগস্টের পর থেকে। সেখানে আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে তার বিভিন্ন ছবিও দেয়া আছে।
ওসমান পরিবারের নির্দেশে ৫ আগস্টের পর আগে জুলাই থেকে শুরু হওয়া টানা আন্দোলনে একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান। তাকে ঢাকা কিংবা নারায়ণগঞ্জের আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় দেখা যায়নি। সাধারণ কর্মসূচীতে থাকলেও ছাত্র জনতার পাশে ছিলেন না তিনি। একদিনের জন্যও ছাত্র জনতার পাশে চাষাঢ়ায় আসেননি এই নেতা, এমনকি হেফাজতের নেতাদেরকেও তিনি আসতে নিষেধ করতেন এমন অভিযোগও আছে। আন্দোলন চলাকালীন রাজপথে একটি ছবিও দেখাতে পারবেন না ফেরদাউস এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এমনকি ৫ আগস্ট ঢাকায় নিজেও যাননি এবং তার অনুগত নেতাকর্মীদের যেতেও নিষেধ করেছিলেন ফেরদাউস। তবে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে হেফাজতের ব্যানারে সবচেয়ে বেশী সক্রিয় হয়ে উঠেন এ নেতা।
হেফাজতে ইসলামের জেলা ও মহানগর এবং সোনারগাঁ থানার একাধিক নেতা জানান, মামুনুল হকের সোনারগাঁয়ের ঘটনার পর রিসোর্টে হামলা ও ভাংচুরের মামলায় হেফাজতের ৪ নেতা মাওলানা ইকবাল, শাজাহান শিবলী, হাফেজ মোয়াজ্জেম হোসেন ও হাফেজ মাওলানা মহিউদ্দিন খানকে র্যাব দিয়ে গ্রেপ্তার করানোর পেছনে কাজ করেছিলেন মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান। রাজধানীর জুরাইন থেকে তাদের গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছিল র্যাব। সূত্র জানায়, সেদিন ৪ জন নয় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানসহ ৫ জন। পরে ফেরদাউসকে ছেড়ে দেয় র্যাব কারণ বাকি ৪ জনকে পরিকল্পনা করিয়ে ধরিয়ে দেন তিনি। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল মারা যান এদের একজন ইকবাল যাকে এখনো স্মরণ করেন মামুনুল হক। তাদের মৃত্যু ও গ্রেপ্তার জন্য দায়ী ফেরদাউসুরের বহিষ্কার চান হেফাজতের অনেক নেতা।
Discussion about this post