প্রাচ্যের ড্যান্ডি হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ যেমন রাজনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী তেমনি ব্যবসা বাণিজ্যের দিক দিয়ে এই জেলাটি দেশের এক নম্বরে স্থান করে নিয়েছে। শিল্পে সমৃদ্ধ এবং রাজনৈতিক হিসেবে নারায়ণগঞ্জ অনেক উন্নতিশীল অবস্থানে থাকলে আমাদের এই জেলাতে নেই তেমন নাগরিক সুবিধা। ছোট্ট এই শহরটি অনেক সুন্দর নগরী হওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক নেতাদের আপোষ নীতির কারণে নারায়ণগঞ্জে দায়িত্বরত প্রশাসনের প্রায় সকল কর্মকর্তারাই লুটপাটের আখড়া হিসেবে নারায়ণগঞ্জে বদলী হয়ে আসেন বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করে ।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ব্যবসা হিসেবে দেশের এক নম্বরে থাকায় বদলী হয়ে আসা আমলা বা সরকারী চাকুরীজীবীগণ যেন এই কারণেই বদলী হয়ে আসতে প্রতিযোগিতায় নামেন। আর নারায়ণগঞ্জে বদলী হয়ে এসেই শুরু করেন নানাভাবে বাণিজ্য। চাকুরীজীবীদের মাথার উপর ভর করে দূর্ণীতিবাজচক্র যার যার পন্থায় নানাভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যেতেও প্রতিযোগিতায় নামে নির্লজ্জভাবে।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে শাসক দল কিংবা বিরোধী জোট জেলার সকল সেক্টরে দূর্ণীতিকে প্রধান্য দিয়ে অসাধু পন্থায় চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারণা। ব্যবসার দিক দিয়ে জেলার বিভিন্ন পাইকারী মোকাম গুলোতে কি পরিমাণ লুটপাট হচ্ছে তা সকলের জানা থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক শেল্টার থাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। নিতাইগঞ্জে গম কেলেংকারী, চাউলের চোরা কারবারী, ভোজ্য তেল, চিনি, লবন কেলেংকারী সহ সকল ধরণের পন্য সামগ্যীর ব্যবসায়ীরা কতটা নগ্ন পথে ভোক্তা সাধারণের সাথে প্রতারণা করছে তার হিসার সাধারণ মানুষ রাখলেও প্রশাসন যেন নির্বিকার। শহরে পাইকারী সূতা, রং কারবারীদের চোরাই পথে ব্যবসার খবর কারো অজানা না থাকলেও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা একেবারেই নিশ্চপ এমন দূর্ণীতির বিষয়ে।
নারায়ণগঞ্জের কোথায় নেই অনিয়ম – দূর্ণীতি ! প্রশাসনের কোন সেক্টর আছে অনিয়ম দূর্ণীতিমুক্ত ? ঘুষ ছাড়া কোন নাগরিক স্বচ্ছ সেবা কি পাওয়া যায় এই জেলায় ? ভুমি অফিসগুলো থেকে সহজেই কি মিলছে সেবা ? এমন হাজারো প্রশ্ন সামনে রেখে জেলার প্রায় প্রতিটি সরকারী দপ্তরে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেছে লোমহর্ষক চিত্র।
হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মূমুর্ষ রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে প্রথমেই তাকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে হয় হরহামেশাই। জেলা শহরের দুটি হাসপাতালে দিনের বেলার আউটডোরে পরীক্ষী নিরীক্ষার নামে নগ্ন ব্যবসা আর মধ্য রাতে চিকিৎসকদের খালী গায়ে বিশ্রাম নেয়ার চিত্র দেখে অসুস্থ্যরা কোনভাবেই আস্থা রাখতে পরছে না বছরের পর বছর জুড়ে।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থায় যে কোন মানুষ বিচার চেয়ে থানা হাজির হলে কতটা ভোগান্তিতে পরতে হয় তা একজন ভূক্তভোগিই জানেন । যে কোন থানায় একটি সাধারণ ডায়রী করতে গেলে টাকা ছাড়া অপারেটর বা ডিউটি অফিসার কি পরিমান তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল্যের স্বীকার হতে হয তা প্রতিনিয়তঃই চোখে পরলেও কেউ এ বিষয়ে কোন ভাবেই প্রতিকার করতে দেখা যায় না।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় কনস্টেবল আমিনুল ইসলাম বন্দর থানা থেকে বদলী হয়ে আসতে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বলে জোড়ালো অভিযোগ উঠেছে। কনস্টেবল বদলীতে কেন এতো ব্যয় এমন প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে বেড়িয়ে আসে এই আমিনুল ইসলাম বন্দর থানায় মুন্সী হিসেবে চাকরীরত অবস্থায় আটককৃত একটি মটর সাইকেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে না জানিয়েই বিক্রি করে দেয় । এমন ঘটনা জানাজানি হলে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় । প্রাথমিক তদন্তে আমিনুল ইসলাম মটর সাইকেল চুরি করে বিক্রির ঘটনা প্রমাণিত হলেই বিষয়ঠি ধামাচাপা দিতেই প্রথমে ১০ লাখ টাকা চুক্তির পর ৭ লাখ টাকা পরিশোধ করে আর গত রোববার সদর থানায় বদলী হয়ে আসার আগে আরো ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃস্টি হয় জেলা পুলিশের সদস্যদের মাঝে।
অনুসন্ধানে আরো বেড়িয়ে আসে আদালত চত্তরে হাজারো বিচারপ্রার্থী নানাভাবে প্রতারণার স্বীকার হচ্ছে প্রতিনিয়তঃ। প্রকাশ্যে আদালতের কার্যক্রম চলাকালেই অধিকাংশ পেসকার পিয়নরা মক্কেলদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়াও প্রতিদিন বিকেলে আদালতের কার্যক্রম শেষে পিয়ন পেসকারদের কেউ কেউ কখনো আইনজীবীর চেম্বারে আবার কোন কোন কর্মকর্তার দপ্তরে হাজির হয়ে সালাম জানাতে দেখা যায়।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারো নারায়ণগঞ্জের প্রায় প্রতিটি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি ফরম ফিলাপের জন্য মাত্রাতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ জোড়ালোভাবে উঠেছে। জেলার রাঘববোয়ালদের অনেকেই শিক্ষানুরাগী হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে বিদ্যালয়ের অর্থ লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। জেলার দুটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েক গজের মধ্যে কোচিং সেন্টারের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে সরকারী চাকুরীরত শিক্ষক/শিক্ষিকাদের অনেকেই। সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা চুক্তিতে ভর্তির নিশ্চয়তাও দিচ্ছে বলে একটি অডিও রেকর্ড হতে নিশ্চিত তথ্য মিলেছে। সরকারী বিদ্যালয়গুলো ছাড়াও শহরের আরো কয়েকটি বিদ্যালয়ে ডোনেশনের নামে আরো কতটা ঘৃন্য কারবার চলছে তা ভূক্তভোগিরাই ভালো জানেন। শিক্ষা নিয়ে শহরের কয়েকজন রাঘববোয়াল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের খাস কামড়ায় গোপন মিটিংয়ের মাধ্যম্যে অর্থ লেনদেন করার চিত্র অনেকের নজরে পরলেও অনৈতিক স্বার্থের কারণে সকলেই কুলুপ এঁটে বসে আছেন যার যার অবস্থানে।
অসংখ্য অভিযোগের তীর রাজনীতিবিদ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হলেও বিশেষ পেশার নাম ব্যবহার করে এবং ব্যাপক দূর্ণীতির সুযোগে পেশাদারিত্ব ছেড়ে জুয়া, নারী ও মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ । এই বিশেষ পেশার অপরাধীদেরকেও কঠোর হস্তে দমন করা উচিৎ ।
এমন হাজারো অনিয়মে এবং লুটপাটের মাধ্যম্যে নারায়ণগঞ্জের বিশাল ক্ষতি হলেও আগামী প্রজন্ম কি নিয়ে এগিয়ে যাবে।
পরিশেষে সৎ রাজনীতিবিদ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ অন্ততঃ নারায়ণগঞ্জের জেলার এমন আবর্জ্জনা পরিস্কার করে আমাদের এই নগরীতে সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হলে জেলাবাসী স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলতে পারবে। অহংকার করতে পারবে আমাদের নারায়ণগঞ্জ নিয়ে।
Discussion about this post